প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক | ছবি রয়টার্স

চিররঞ্জন সরকার: অনেক নাটকীয়তার পর ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাকের নাম চূড়ান্ত হয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিক শপথ নেওয়ার পালা। ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসের চরম অস্থিরতা ও নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের সময় দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তিনি। 

নানা কারণেই ঋষি সুনাকের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। পৃথিবীর সব দেশের, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের আবাসভূমি হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে এখনও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা রয়ে গিয়েছে। সেখানে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হলেও প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি পদে কোনো হিন্দু বা মুসলিম পরিচয়ের কাউকে কখনও দেখা যায়নি।

আমেরিকান ও ব্রিটিশরা মুখে যত বড় বড় বুলিই উচ্চারণ করুক না কেন, তাদের অনেকে এখনও রক্ষণশীল মানসিকতা ধারণ করেন। আমেরিকানরা ‘অশ্বেতাঙ্গ’কে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানলেও এখনও একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাদের এই মানসিকতার কারণেই হিলারি ক্লিনটন শেষ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ব্রিটিশরা নারীর ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতাকে অতিক্রম করলেও ধর্ম ও কালো-সাদা প্রশ্নে যথেষ্ট ‘বর্ণবাদী’। ‘সাদা চামড়া’র বাইরে সেখানে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেনি। এই রক্ষণশীল মানসিকতার কারণে প্রথম দফায় ঋষি সুনাকেরও ভাগ্যের শিকে ছেড়েনি। বরিস জনসন ইস্তফা দেওয়ার পরে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কনজ়ারভেটিভ মন্ত্রীদের সব থেকে পছন্দের প্রার্থী ছিলেন এই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু দলের সাধারণ সদস্যদের ভোটাভুটিতে লিজ় ট্রাসের কাছে হেরে যান তিনি। তার হারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওই সময় অনেকেই বলেছিলেন, ‘হিন্দু’ পরিচয়ই সুনাকের সামনে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা না হলে তাকে বাদ দিয়ে লিজ ট্রাসকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর কোনো যুক্তি ছিল না। সব দিক থেকেই ঋষি সুনাক ছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। বরিস জনসনের আমলে চ্যান্সেলর ও অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তিনি যেভাবে মন্ত্রণালয় সামলেছেন, কোভিড পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ধরে রেখেছিলেন, তাতে তাকেই সেধে প্রধানমন্ত্রী বানানোর কথা ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা তা করেনি। তারা বেছে নিয়েছিলেন তুলনামূলকভাবে লো-প্রোফাইলের ব্যক্তিত্ব লিজ ট্রাসকে। ট্রাস ৪৫ দিনও টিকতে পারেননি। ট্রাসের কাছে পারাজিত ঋষি সুনাককেই এবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হয়েছে। এর কারণ কী? ব্রিটিশরা এত দ্রুত কী করে তাদের রক্ষণশীল মানসিকতা ঝেড়ে ফেললেন?

আসলে রক্ষণশীলতা তাদের এখনও আছে। কিন্তু তারা এখন বড় বিপদে পড়েছে। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে ঋষিকে পছন্দ করা ছাড়া আপাতত অন্য কোনো বিকল্প নেই। কারণ ঋষি নিজ যোগ্যতায় অপরিহার্য নেতায় পরিণত হয়েছেন। ভঙ্গুর অর্থনীতি সামাল দিতে ট্রাসের ‘টোটকা’ যে ব্যর্থ হতে চলেছে, তা তিনি ওই সময়েই ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছিলেন। তা-ই বাস্তবে ঘটে যাওয়ায় এখন অধিকাংশ নেতাই নিজেদের ভুল মেনে নিয়েছেন। তারা এখন বুঝতে পারছেন, আসলে ঋষিই পারবেন এই সঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে। তাই, এই পরিস্থিতিতে আর ঋষির অশ্বেতাঙ্গ বা ‘হিন্দু পরিচয়’ বড় হয়ে দাঁড়ায়নি। এই প্রথম ব্রিটিশরা সত্যিকার অর্থেই প্রমাণ দিয়েছেন যে, তারা মেধা ও বৈচিত্র্যে বিশ্বাস করে!

ঋষি সুনাক যখন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, তখন যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে উথাল-পাথাল অবস্থা চলছে। ছয় বছরে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছেন। এর মধ্যে ব্রেক্সিটের কারণে সরে যেতে হয়েছে ডেভিড ক্যামেরন, থেরেসা মে-কে। ২০১৯ সালে বিপুল ভোটে প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন। তিনি ব্রেক্সিট ইস্যু সফলভাবে মোকাবিলা করলেও করোনা নিয়ে সমালোচনার শিকার হন। সামাজিক দূরত্ব না মেনে পার্টির আয়োজন করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন ‘খামখেয়ালি’ বরিস। এ ঘটনার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে এবং জরিমানা দিতে বাধ্য হন। তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। তীব্র অসন্তোষের মুখে শেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। 

এর পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বরিসের স্থলাভিষিক্ত হন লিজ ট্রাস। তিনি মূলত ধনীদের কর কমিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু ১০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, পাউন্ডের পতন, বন্ধকের হার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণগুলো ট্রাসকে অথই সাগরে ফেলে দেয়। এর মধ্যে একটা ‘মিনি বাজেট’ ঘোষণা করে সেখানে করপোরেশন কর কমানো, সবার জন্য প্রযোজ্য আয়করে ১ শতাংশ ছাড় এবং জাতীয় বিমার চাঁদা বাড়ানোর আগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। ব্যাংকারদের বোনাসের সীমা তুলে দেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চরমে ওঠে। ওই বিক্ষোভের জেরেই শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় তাকে। 

আসলে ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, দুর্বল নেতৃত্ব, দলীয় ও ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে দেশের ওপরে স্থান দেওয়া, রাজনৈতিক মেরুকরণ, জনপ্রিয় ভাবনা থেকে অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি কারণে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করাটাই এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেন ও আমেরিকার অত্যন্ত নামাজাদা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা ধনাঢ্য রাজনীতিবিদ ঋষি সুনাকের দিকে ব্রিটিশ জনগণ তাকিয়ে আছে।

তরুণ তুর্কি হিসাবে কনজারভেটিভ পার্টিতে একজন জনপ্রিয় মুখ। বরিস জনসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আগে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর একনিষ্ঠ সমর্থন ছিলেন। ‘ইরোপিয়ান ইউনিয়ান’ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে প্রচারে তিনি বরিসের সঙ্গী ছিলেন। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় ব্যবসায়ী এবং কর্মচারীদের জন্য বিপুল অর্থমূল্যের আর্থিক প্যাকেজ তৈরি করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেই সময় তার দলের ওয়েবসাইটে তাকে ‘পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

তবে রাজনীতি এসে একাধিকবার বিতর্কে জড়িয়েছেন ঋষি। ব্রিটেনের সংসদের নিম্ন কক্ষ ‘হাউস অব কমন্সে’ শপথ নেন গীতা নিয়ে। কোভিড বিধি না মেনে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) যে পার্টির ডাক দেন বরিস, সেখানে অংশগ্রহণ করে তিনিও বিতর্কিত হন।

এ ছাড়া ইনফোসিসে তার স্ত্রী অক্ষতা মূর্তির অংশীদারত্ব এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত আয় বাবদ অর্থের ওপর কর না দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছিল। ব্রিটেনের কর ব্যবস্থায় তার স্ত্রী অক্ষতাকে ‘নন-ডোমিসাইলড’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ব্রিটেনের স্থায়ী নাগরিক যারা নন তাদের এই তকমা দেওয়া হয়।

এসব বিতর্ক ও সমালোচনাকে অতিক্রম করে মাত্র ৪২ বছর বয়সে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়ে নতুন ইতিহাস গড়ছেন ঋষি। অনেক বড় দায়িত্ব ও প্রত্যাশার চাপ নিয়ে এবার তাকে কুর্সিতে বসতে হচ্ছে। তার কর্মদক্ষতাই বলে দেবে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতদিন থাকতে পারবেন। শুধু তাই নয়, তার কাজের ওপরই নির্ভর করবে আগামী সাধারণ নির্বাচনে কনজ়ারভেটিভ পার্টির ভাগ্য। তাই, দলের স্বার্থের কথাও বেশি করে মাথায় রাখতে হবে তাকে।

ওই বিবেচনায় ঋষি সুনাকের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা গৌরবের হলেও মোটেও স্বস্তির হবে না। সামগ্রিকভাবে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। জিডিপির সংকোচন হচ্ছে। সরকারি ঋণের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

এদিকে পাউন্ডের দরপতনের কারণে যেসব পণ্য অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়, ওইসব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ডলার বা ইউরোর বিপরীতে পাউন্ডের দরপতন হলে যেসব পণ্য এসব মুদ্রায় আমদানি করতে হয়, সেগুলোর মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। এমন সময়ে তা ঘটছে, যখন ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। বিরোধী দলগুলোও কিন্তু চুপ করে বসে নেই। শাসকদলের ক্রমাগত ব্যর্থতা ও গৃহবিবাদের সুযোগে তারা নতুন নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে। আর দলের মধ্যে ‘বিভীষণেরও’ কোনো অভাব নেই। বরিস-ট্রাসরা এত সহজে ঋষিকে ছেড়ে কথা বলবেন বলে মনে হয় না। ফলে ঋষির কপালে দুঃখ আছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তবে তিনি কোনো এক আশ্চর্য ‘জাদু-মন্ত্র’ বলে যদি সব প্রতিকূলতা জয় করতে পারেন, তাহলে ব্রিটিশ রাজনীতিতে অমর হয়ে থাকবেন।