ঋষি সুনাক | ছবি: রয়টার্স |
পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক। এতে উচ্ছ্বসিত অনেক ভারতীয়। সুনাকের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত ভারতের জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার লোকজন। এমনকি দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাও সুনাকের সাফল্যে কিছুটা হলেও খুশি।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয়দের এই উচ্ছ্বাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে চোখ বোলালে। ভারতের সর্বাধিক পঠিত সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনামটা ছিল এমন—যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হলেন ‘গর্বিত হিন্দু’ ঋষি সুনাক। তাদের খবরে হিন্দু শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে পাঁচবার। ইন্ডিয়া টুডের শিরোনাম—হিন্দু হয়েও ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে। তবে তারা এটাও বলেছে, সুনাক হিন্দু হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রিত্ব পাননি।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দিকে ইঙ্গিত করেও শিরোনাম করেছে অনেক সংবাদমাধ্যম। যেমন টেলিগ্রাফ। তাদের শিরোনাম, ‘সুনাক: এক্স-ইন্ডিয়া কোম্পানি যুক্তরাজ্যের হাল ধরতে যাচ্ছেন’। এখানে ‘এক্স-ইন্ডিয়া কোম্পানি’ বলতে বোঝানো হয়েছে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। প্রতিষ্ঠানটি গায়ের জোরে ভারতের বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। আর দৈনিক ভাস্করের শিরোনাম, ‘জাতির জন্য দীপাবলির আরেকটি উপহার। শ্বেতাঙ্গদের শাসন করতে যাচ্ছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি।’
সংবাদমাধ্যমের শিরোনামের বাইরেও অনেক ভারতীয় মনে করছেন, সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা ভারতের জন্য লাভজনকই হবে। গত আগস্টে উত্তর লন্ডনে ব্রিটিশ-ভারতীয়দের নিয়ে একটি প্রচারণা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন সুনাক। সেখানে হিন্দিতে কথা বলেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের আরও উন্নয়নে কাজ করবেন।
ঋষি সুনাক ভারতীয়দের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তাঁর ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্য দিয়েও। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র ভাগবত গীতায় হাত রেখে তিনি যুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতা হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে হিন্দুধর্মে পবিত্র প্রাণী গরুর পূজা দিতে দেখা গেছে তাঁকে। দীপাবলিতে নিজের সরকারি বাসভবনে প্রদীপ জ্বালান তিনি। সুনাক ভালোবাসেন ক্রিকেটও। ক্রিকেট ভারতীয়দের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।
সুনাকের শ্বশুর এনআর নারায়ণ মূর্তি একজন ধনকুবের। তিনি ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি ভারতের গর্ব। নিজের মেয়ে অক্ষতা মূর্তির কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি সুনাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। তখন সুনাক-অক্ষতার বিয়েও হয়নি।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে যখন লিজ ট্রাসের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন ঋষি সুনাক, তখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল। ভারতীয়দের এমন আচরণকে হাস্যকর উল্লেখ করেছেন অনেকে। তবে শিক্ষাবিদ ও লেখক কাঞ্চা ইলাইয়াহ শেফার্ডের মতো অনেকেই একে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এটাই বোঝাচ্ছে যে যুক্তরাজ্যের ভোটার ও রাজনীতিকদের মধ্যে ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি সহনশীলতা নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে।
বিদেশে যেসব ভারতীয় পেশাগত সাফল্যের শীর্ষে ওঠেন, তাঁদের নিয়ে দেশটির নাগরিকদের ব্যাপক উৎসাহ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসকারী ভারতীয় লেখক সলিল ত্রিপাঠি। তিনি বলেন, সুন্দর পিচাই গুগল, কিংবা সত্য নাদেলা মাইক্রোসফটের প্রধান হলে গর্বে ভারতীয়দের বুক ফুলে ওঠে। নাদেলা-পিচাইদের এই সাফল্য দিয়ে ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায় তারা। তবে সত্যটা হলো, এই মানুষগুলোর ওপরে ওঠার পেছনে রয়েছে ভিন্ন একটি বিষয়।
সলিল ত্রিপাঠির ভাষ্যমতে, নাদেলা, পিচাই বা সুনাককে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সময় একটি বিষয় এড়িয়ে যান ভারতীয়রা। সেটি হলো সমাজে তাঁরা কোন শ্রেণির। সুনাক পড়ালেখা করেছেন অভিজাত একটি স্কুলে। অক্সফোর্ড ও স্ট্যানফোর্ডের মতো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। যেসব ভারতীয় করপোরেট জগতে সাফল্য পেয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই দেশটির অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখার পাট চুকিয়েছেন।
ঋষি সুনাক | ছবি: রয়টার্স |
সলিল ত্রিপাঠি বলেন, যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টিতে যে কয়জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিক আছেন, তাঁরা এমন সব এলাকার প্রতিনিধিত্ব করছেন, যেগুলো আগে থেকেই দলটির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ফলে তাঁরা ভারতীয়দের কাছে তেমন একটা গুরুত্ব পাননি। তবে সুনাকের বিষয়টি আলাদা। কারণ, তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দেশটির উপনিবেশবাদের একটি নোংরা অতীত রয়েছে, সমাজে এখনো দেখা যায় জাতপাত ভেদ-বর্ণবাদ। ব্রিটিশরা ভারতীয়দের ওপরও শাসন করেছে।
ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের একজন ভালো প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে মনে করেন কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়ার পরিচালক নায়াজ কাজি। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য ও ভারত দুই দেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে কাজ করছে। এ সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে সহায়ক হবেন সুনাক। তিনি ব্যাপক অভিজ্ঞ। করোনা মহামারির সময় মানুষের চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজের দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি।
এফটিএ নিয়ে যুক্তরাজ্য ও ভারত আলোচনা শুরু করেছিল চলতি বছরে জানুয়ারিতে। চুক্তিটির অগ্রগতি এই মুহূর্তে থমকে আছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদারের ক্ষেত্রে ঋষি সুনাকের প্রধান কাজ হবে চুক্তিটি সামনে এগিয়ে নিতে তৎপর হওয়া। এফটিএর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে চামড়া, অলংকার, পোশাক ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাড়াতে চাইছে ভারত। একই সঙ্গে ভারতীয় শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের জন্য যুক্তরাজ্যের ভিসার পরিমাণও বাড়াতে চাইছে দেশটি।
ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রিত্বে যুক্তরাজ্য ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলে মনে করেন দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হ্যাপিমন জ্যাকবও। তাঁর কথায়, এর কারণ এটা না যে সুনাক একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। কারণ হচ্ছে, তাঁর শাসনামলে দুটি বিষয় ঘটতে পারে। একটি হলো এফটিএ। আর একটি হচ্ছে, চীন যে হুমকি, সে বিষয়ে যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গি আরও পরিষ্কার হবে। সম্প্রতি এক প্রচারণা চালাতে গিয়ে চীনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছিলেন সুনাক।
এ বিষয়ে দিল্লিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় বারু বলেন, ভারত হয়তো ঋষি সুনাকের অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে থাকবে না। কারণ, যুক্তরাজ্যে তাঁকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। তাই আপাতত ভারতীয়দের ধৈর্য ধরেই থাকতে হচ্ছে।