সিত্রাংয়ের প্রভাবে সৃষ্ট আবহাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে মাইকিং করছে কোস্টগার্ডের সদস্যরা। সোমবার বরিশাল নগরের ডিসি ঘাট এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের সর্বত্র ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বরিশাল বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন আজ সোমবার বিকেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করেছে। দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির স্বেচ্ছাসেবকেরা সংকেত প্রচার এবং চর ও দূরবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে সরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে।

সকাল থেকে টানা মাঝারি বর্ষণে বিভাগের অনেক জেলা ও উপজেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বরিশালেও সকাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এতে ফোন, ইন্টারনেট যোগাযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। একই সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে জরুরি রোগীদের অস্ত্রোপচার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারের সভাপতিত্বে বিকেলে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় জানানো হয়, বরিশাল জেলায় ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যেখানে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৯৯০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী (শুকনা খাবার, সুপেয় পানি), মোমবাতি, ওষুধপত্রের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এ ছাড়া উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন-সরঞ্জামাদিসহ প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মেডিকেল টিমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি জেলার সব স্থানে মাইকিং ও আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

বিভাগের অন্য পাঁচ জেলাতেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা হয়েছে এবং সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বেলা তিনটায় বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. আমিন উল আহসানের সভাপতিত্বে প্রস্তুতি সভায় বিভাগের জেলা প্রশাসকেরা অনলাইনে সংযুক্ত ছিলেন। সভায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি এবং উদ্ধার তৎপরতায় নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয়ে খোঁজখবর নেন বিভাগীয় কমিশনার। একই সঙ্গে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।

বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান বলেন, সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। একই সঙ্গে গবাদিপশুর আশ্রয়ের জন্য মুজিব কেল্লাগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তাঁরা প্রস্তুত। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে এরই মধ্যে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে।

এদিকে বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা সদরে সকাল থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এই দুই জেলার অনেক উপজেলায় বিদ্যুৎ নেই গতকাল রোববার রাত থেকে। ফলে এসব এলাকার ফোন, ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোয় জরুরি রোগীদের অস্ত্রোপচার ব্যাহত হচ্ছে। আজ দুপুরে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসুরা বেগম নামের এক জরুরি প্রসূতি রোগীকে টর্চলাইট জ্বেলে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে চিকিৎসকদের। হাসপাতালের গাইনিবিশেষজ্ঞ জাকিয়া সুলতানা, তানিয়া আফরোজ, ফেরদৌসী আক্তার, অবেদনবিদ হাবিবুর রহমান ও ইন্টার্ন চিকিৎসক আল ইমরান ওই প্রসূতির অস্ত্রোপচার করেন।

ওই প্রসূতির পর্যবেক্ষণে থাকা হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক মেহেদী হাসান বলেন, ‘ওই প্রসূতির অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল ছিল। দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে তাঁর নিজের জীবনই বিপন্ন হতে পারত। এ জন্য আমরা দ্রুত দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে তাঁকে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিই। বিদ্যুৎ না থাকায় টর্চলাইট জ্বেলে এ অস্ত্রোপচার করা হয়।’

তিনটি কারণে ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে
এদিকে টানা বৃষ্টি আর ঝোড়ো বাতাসে উপকূলে পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে দমকা ও ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। এ জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অনেক এলাকার লোকজনকে নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে। বরগুনার তালতলী উপজেলার বড়বগি ইউনিয়নের নয়াপাড়া স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টারে অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছে। সঙ্গে গবাদিপশুকেও নিরাপদে নিয়ে আসা হয়েছে। 

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন মিয়া বলেন, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব ধরনের মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার চলাচল বন্ধ রাখার জন্য বলা হয়েছে। সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা পতাকা উত্তোলন ও মাইকিং করে লোকজনকে সতর্ক করার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার কাজ করছেন। এ লক্ষ্যে বরিশাল অঞ্চলে ৩২ হাজার ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক মাঠে রয়েছেন।

বরিশাল আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এখন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। এটি এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকেই। এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইছে, হচ্ছে প্রচুর বৃষ্টি। ঘূর্ণিঝড়ে ১৩ জেলায় ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশাল।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ এখন বাংলাদেশের উপকূল থেকে ১৪৩ কিলোমিটার দূরে আছে। আর কেন্দ্রস্থল আছে ৪০০ কিলোমিটার দূরে। সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ আজ সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে উপকূলের দিকে আঘাত হানতে পারে। এর কেন্দ্র বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনে আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টার দিকে বাংলাদেশের স্থলভাগ অতিক্রম করতে পারে। এর অগ্রভাগ আঘাত করবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট থেকে শুরু করে ফেনী ও নোয়াখালী পর্যন্ত। আর কেন্দ্র পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও ভোলা জেলায় আঘাত করতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সিত্রাং বড় আকারের ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে। এ জন্য তারা তিনটি কারণের কথা বলছে। কারণ তিনটি হলো ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য। তবে আগাম বৃষ্টির কারণে এর শক্তি অনেকটা ক্ষয় হতে পারে। এতে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় সম্ভাব্য বড় তাণ্ডবের শক্তি হারাতে পারে।

বরিশাল আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ঝড়টি উপকূলের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। প্রবল বর্ষণের কারণে এটা স্থলভাগ অতিক্রমের সময় কেন্দ্রের বাতাসের গতি কিছু হলেও কমে যাবে। তবে ঝড়টি মধ্যরাতের আগেই বরিশাল উপকূলের স্থলভাগ অতিক্রম করতে পারে।