বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তথ্যসূত্র: জিএইচআই

বিশেষ প্রতিনিধি:  ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আট ধাপ অবনতি হয়েছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) এ বছর ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ থেকে ৮৪তম স্থানে নেমে এসেছে। গত বছর ১১৭টি দেশের মধ্যে ওই জরিপ করা হয়েছিল। ২০২০ সালে ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৫তম।

বৃহস্পতিবার আয়ারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও জার্মানভিত্তিক ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ যৌথভাবে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২২ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। চলতি বছরের ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ ১৯ দশমিক ৬ স্কোর পেয়েছে। ক্ষুধা সূচক ১০ থেকে ১৯ দশমিক ৯–এর মধ্যে থাকলে ওই দেশ ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধা আক্রান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

এ বছরের প্রতিবেদনের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান ক্ষুধা মেটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে। দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ১০৭ ও ৯৯তম। এ দেশ দুটি ‘মারাত্মক ক্ষুধায়’(স্কোর ২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯) আক্রান্ত দেশের তালিকায় রয়েছে।

কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের সিইও ডমিনিক ম্যাক সরলি এ ব্যাপারে বলেন, বিশ্বজুড়ে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ মহামারির সম্মিলিত প্রভাব পড়েছে। এখন রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সরবরাহ এবং খাদ্য, সার ও জ্বালানির মূল্যে আঘাত হেনেছে। এ সংকট ধীরে ধীরে বিপর্যয়কর রূপ নিতে শুরু করেছে।

প্রতিবেদনটিতে ক্ষুধা নিবারণে বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক অবনতির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫০টি দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের গমের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সময়মতো ওই দুই দেশ থেকে গম কিনতে না পারায় চাল ও আটার দাম বেড়ে গেছে। যে কারণে গরিব মানুষের পক্ষে খাদ্য কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে সারের দামও আকাশচুম্বী হয়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ২০২০ থেকে ২০২২–এর মধ্যে বিশ্বজুড়ে দানাদার খাদ্যের দাম ৩৭ শতাংশ ও ভোজ্যতেলের দাম ৫৬ শতাংশ ও মাংসের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে।

অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক বা জাতীয়—যেকোনো পর্যায়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ণয় করতে এ সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ওই সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের এক–তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত, প্রতি ছয়জনের একজন শিশু বয়সের তুলনায় খর্বকায় ও কৃশকায়। এ ছাড়া প্রতি তিনজনের একজন শিশু জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়। এই সব কটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় তা কম। যে কারণে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে।

চলতি বছরের এ সূচকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ওপরে আছে শ্রীলঙ্কা। ১৩ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে দেশটির অবস্থান ৬৪তম। এরপর ১৫ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে ৭১তম স্থানে মিয়ানমার।

ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী, অন্তত নয়টি দেশে ক্ষুধার মাত্রা ‘উদ্বেগজনক’ (স্কোর ৩৫ থেকে ৪৯ দশমিক ৯) পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই দেশগুলো হলো মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, চাদ, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, মাদাগাস্কার, ইয়েমেন, বুরুন্ডি, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান ও সিরিয়া। এ ছাড়া আরও ৩৫টি দেশে ‘গুরুতর ক্ষুধা’ (স্কোর ২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯) পরিস্থিতি আছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে গুরুতর ক্ষুধা পরিস্থিতি বিরাজ করছে দক্ষিণ এশিয়ায়। এরপরই রয়েছে সাহারা মরুভূমি এলাকার আফ্রিকার দেশগুলো।

পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় ক্ষুধা মাঝারি পর্যায়ে আছে; যেখানে ক্ষুধা প্রশমনের উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তবে বিশ্বে ক্ষুধা কম মাত্রায় আছে লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবীয়, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায়।

সূচকে ৫-এর নিচে স্কোর পেয়ে শীর্ষ ১৭ দেশের তালিকায় আছে বেলারুশ, হার্জেগোভিনা, চিলি, চীন, ক্রোয়েশিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, কুয়েত, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মন্টিনিগ্রো, নর্থ মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, স্লোভাকিয়া, তুরস্ক ও উরুগুয়ে। অর্থাৎ বিশ্বের এসব দেশে ক্ষুধা কম। তবে সূচকে একেবারে তলানিতে অবস্থান করছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন। ৪৫ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে দেশটি ১২১তম অবস্থানে আছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে খাদ্য পরিস্থিতি যে জায়গায় যাচ্ছে, তাতে আমাদের নিজেদের প্রধান খাদ্যগুলো নিজেদেরই উৎপাদনে জোর দিতে হবে। বিশ্ববাজার থেকে আমদানির ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রধান সরবরাহকারী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।’