পরেশ চন্দ্র | ছবি: সংগৃহীত

প্রতিনিধি জয়পুরহাট: পরেশ চন্দ্র মারা গেছেন ১৯৯৪ সালে। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল শাখার নথি বলছে, মৃত্যুর ১১ বছর পর পরেশ চন্দ্র আবার জীবিত হয়েছিলেন। তিনি জীবিত হয়ে নিজের বাড়িতে যাননি। পরিবারের সদস্য কিংবা গ্রামের মানুষও তাঁকে দেখেননি। পরেশ চন্দ্র শুধু গিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায়। ওই দিন ক্ষেতলাল শাখা থেকে তিনি ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করে ১০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছিলেন।

ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের পাঁচুইল গ্রামের মৃত কৈলাশ চন্দ্রের ছেলে পরেশ চন্দ্র। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক থেকে পরেশ চন্দ্রের নামে ১০ হাজার টাকা এমসিডি ঋণ পরিশোধের জন্য এক নোটিশ পাঠানো হয়। ডাকযোগে পাঠানো ব্যাংকের রেজিস্ট্রি করা চিঠিটি মৃত পরেশ চন্দ্রের বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র গ্রহণ করেন। চিঠি খুলে তিনি তাঁর বাবার নামে ব্যাংকের ১০ হাজার টাকার এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেখতে পান।

নরেশ চন্দ্র বলেন, নোটিশে একনজর বুলিয়ে ভেবেছিলেন, তাঁর বাবা জীবিত থাকতে হয়তো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। তবে এত দিন পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেওয়ায় তাঁর মনে খটকা লাগে। পরে চিঠির নিচের অংশে গিয়ে দেখেন, ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর তাঁর বাবা ঋণ গ্রহণ করেছেন। অথচ তাঁর বাবা পরেশ চন্দ্র ২৮ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন মারা গেছেন।

এমন অদ্ভুত চিঠি পেয়ে নরেশ ছুটে যান সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায়। তবে ব্যাংকের কর্মকর্তারা নথিপত্র ঘেঁটে জানান, ঋণ গ্রহণের তারিখ ঠিক আছে। এ সময় নরেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বলেন, তাঁর বাবা ২৮ বছর আগে মারা গেছেন। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাঁদের দাবিতে অনড় থাকেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, ঋণের নথিতে পরেশ চন্দ্রের নাগরিকত্ব সনদ, ছবি, জমির কাগজপত্র ও স্বাক্ষর—সবই আছে।

নরেশের অভিযোগের বিষয়ে জানতে স্থানীয় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায় যান এই প্রতিবেদক। ব্যাংকে রক্ষিত ৩২৮ নম্বর এমসিডি ঋণের নথিপত্রে পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। ছবি-নাগরিকত্ব সনদ, জমির কাগজ দিয়ে পরেশ চন্দ্র ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর দিয়ে ১০ হাজার ঋণ গ্রহণ করেছেন বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যাংকের পাঠানো নোটিশের সঙ্গে তথ্যের মিল পাওয়া গেছে। তবে আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে নরেশের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

পরেশ চন্দ্রের বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

আলমপুর ইউপিতে ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মৃত্যু রেজিস্ট্রার খোলা হয়। ওই রেজিস্ট্রারের ৩৮ নম্বর পাতার ৪৩ নম্বর সিরিয়ালে পাঁচুইল গ্রামের পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। তাঁর মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে বুকের ব্যথার কথা উল্লেখ রয়েছে। আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০২১ সালের ৯ মার্চ নরেশ চন্দ্রকে তাঁর বাবার মৃত্যুসনদ দেওয়া হয়েছে। ওই সনদেও মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন উল্লেখ করা হয়েছে।

নরেশ চন্দ্র বলেন, ‘১০ হাজার টাকা বড় কথা নয়। আমার বাবা মৃত্যুর ১১ বছর পর কীভাবে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ গ্রহণ করলেন, তাতে আমরা আশ্চর্য হয়েছি। মৃত্যুর পর আমার বাবা জীবিত হয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন, সেটা সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা ছাড়া আর অন্য কেউ দেখেননি। এর আগে আমরা কখনো বাবার নামে থাকা ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাইনি।’

আলমপুর ইউপির চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার বলেন, পাঁচুইল গ্রামের পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর তারিখ ইউপি কার্যালয়ের মৃত্যু রেজিস্ট্রারেই উল্লেখ রয়েছে। ইউপি কার্যালয় থেকে পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর সনদও দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর ১১ বছর পর ব্যাংক তাঁকে ঋণ দিয়েছে, এটা খুবই আশ্চর্যজনক। ক্ষেতলাল সোনালী ব্যাংকে একসময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল। তখন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল বলে দাবি করেন তিনি।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার ব্যবস্থাপক সিনিয়র প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব বলেন, ব্যাংকের ঋণ নথিতে দেখা গেছে, পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালে কাগজপত্র ও স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ঋণটি পরিশোধ হয়নি। এখন ঋণটি শ্রেণিকৃত হয়েছে। এ কারণে ঋণের আসল টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

মৃত ব্যক্তি কীভাবে ঋণ পেলেন জানতে চাইলে আহসান হাবিব বলেন, ‘তখন আমি এখানে শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলাম না। এ কারণে সেটি আমার জানার কথাও নয়। তবে একসময় এ শাখায় কৃষি, এমসিডি ও ছাগল ঋণে অনিয়ম হয়েছিল বলে শুনেছি।’

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার কোটি টাকার কৃষি ও এমসিডি ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এর ৮০ শতাংশ অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল। ওই সময় ব্যাংকের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তা এসব অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।