অলংকরণ: আরাফাত করিম |
মানসুরা হোসাইন: বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিকল্পনায় ‘মনঃসামাজিক উন্নয়ন’ একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিষয়টিকে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং জাতীয় বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হবে।এ কথাগুলো লেখা ছিল জাতীয় মনঃসামাজিক কাউন্সেলিং নীতিমালা ২০১৬–এর খসড়ায়। তবে খসড়াটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খসড়া হিসেবেই ঝুলছে।
খসড়া অনুযায়ী মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের নীতিমালাটি সমন্বয় করার কথা ছিল। মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের অধীন চলছে এ ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার।
নীতিমালার খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের তখনকার প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘খসড়া প্রণয়ন করে তা মন্ত্রণালয়ে জমা দিই। আলোচনা–পর্যালোচনা শেষে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকারের তালিকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ বিভিন্ন বিষয় চলে আসায় নীতিমালার খসড়াটি আর আলোর মুখ দেখেনি।’
তবে আবুল হোসেন বলেন, বাল্যবিবাহসহ সমাজ থেকে নানান নির্যাতন ও অসংগতি দূর করার জন্যই এ ধরনের একটি নীতিমালা থাকা জরুরি ছিল। তবে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হলেও বরাবরই অবহেলিত থেকে গেছে বলেই নীতিমালাটিও গুরুত্ব পায়নি।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নার্গিস খানম। তিনি বলেন, নীতিমালার খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে যে কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের এখন অনেকেই নেই। মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নীতিমালার খসড়া নিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
দেশে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে দিন দিন উদ্বেগ বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯ অনুযায়ী, দেশের ২ কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। শতকরা হিসাবে তা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
আজ ১০ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটি সামনে রেখে সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত, অর্থাৎ ৮ মাসে গণমাধ্যমে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৪ জন স্কুলশিক্ষার্থী। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে গড়ে ৪৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আর সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশই স্কুলের শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭৯ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ২০ বছর। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৩ মাসে গণমাধ্যমে ১৫১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বছরের আট মাসে তা দ্বিগুণের বেশি।
সরকার মনঃসামাজিক কাউন্সেলিং নিয়ে নীতিমালার যে খসড়া করেছিল, তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণি–পেশার মানুষের চাপ কমাতে ও রাগ নিয়ন্ত্রণে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তার উল্লেখ ছিল। আত্মহত্যা ও এর প্রবণতার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক রোগনির্ণয়ের সম্পর্ক আছে বলে উল্লেখ ছিল খসড়ায়।
গত ২৩ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে হলি ক্রস স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী পারপিতা ফাইহা। গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর দক্ষিণখান মোল্লারটেক এলাকার একটি ১০ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজানা মোসাদ্দেক (২১)।
পারপিতা ফাইহা পড়াশোনার চাপসহ বিভিন্ন চাপের মধ্যে ছিল। আর সানজানা মোসাদ্দেকের (২১) আত্মহত্যার পেছনে ছিল পারিবারিক নানান অশান্তির ঘটনা। নীতিমালার খসড়ায় এসব পারিবারিক অশান্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে বলা ছিল।
নীতিমালার খসড়ায় যা ছিল
খসড়ায় মনঃসামাজিক কাউন্সেলিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মানসিক ও সামাজিক উপাদানসমূহের সমন্বয়ে একটি সেবামূলক ব্যবস্থা, যা মনোবৈজ্ঞানিক নীতিমালা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক গুণাবলির পৃথক পৃথক ও সামগ্রিক উৎকর্ষ সাধন ও সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে। এ সেবা ইতিবাচক মনোভাব গঠনের জন্যও প্রয়োজন। মা–বাবার দক্ষতা বাড়ানো থেকে শুরু করে রাগ নিয়ন্ত্রণ, চাপ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি জীবনমুখী দক্ষতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। যেকোনো দুর্ঘটনা–পরবর্তী মানসিক সংঘাতের প্রভাব নিরাময় করে কর্মজীবনে ফিরতে সহায়তা করবে।
উন্নত বিশ্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংস্থা, শিল্পকারখানায় মনঃসামাজিক কাউন্সেলর দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৯ সালের ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা চালুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করেই এ নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। নীতিমালায় কোন স্তরে কোন ব্যক্তিরা সেবা দেবেন, তা ঠিক করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল নীতিমালা তৈরি হলে জবাবদিহির পাশাপাশি পরিবীক্ষণব্যবস্থা শক্তিশালী করা সম্ভব হবে।
নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করা, সৃজনশীলতার বিকাশ হবে বলে উল্লেখ ছিল। কর্মক্ষেত্রে পারস্পরিক পেশাগত সুসম্পর্ক বজায় রাখা, সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ তৈরি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সমাজে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার, যৌনকর্মীদের মূলস্রোতে সম্পৃক্ত করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।
খসড়ায় বিয়ের আগে পারস্পরিক বোঝাপড়া, বিয়ের গুরুত্ব, বিয়ের পরবর্তী জীবন নিয়েও যাতে মানুষ কাউন্সেলিং পেতে পারে, তার ব্যবস্থার কথা বলা ছিল। আর এসবের জন্য বিবাহ নিবন্ধকদের বিবাহপূর্বক কাউন্সেলিংবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি গাইডলাইন দেওয়া হবে বলে উল্লেখ ছিল।
সুখী দাম্পত্য জীবন নিশ্চিতে জেলা ও উপজেলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তাকে এবং সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে দাম্পত্য কাউন্সেলিংবিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং ব্যবহারিক ম্যানুয়াল দেওয়া হবে। বিবাহবিচ্ছেদ, কিশোর–কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন জটিলতাসহ এ ধরনের সমস্যা সমাধানে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা এবং সমাজকল্যাণ কর্মকর্তাদের বিচ্ছেদ ও মানসিক অবস্থাবিষয়ক কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনে দেশব্যাপী কাউন্সেলিং–সেবা দেওয়ার কথা ছিল। সন্তান জন্মের আগে ও পরে নারী ও পরিবারের সদস্যরা যাতে কাউন্সেলিং–সেবা পান, সে বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল খসড়ায়।
শিশুর বিকাশ, যৌন শিক্ষা বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়) দক্ষ মনঃসামাজিক কাউন্সেলর নিয়োগের কথা বলা ছিল খসড়ায়। অভিভাবকদের জন্যও সচেতনতামূলক নানান কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা ছিল। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এবং কর্মকর্তাদের সম্পর্ক ভালো করার জন্য খণ্ডকালীন কাউন্সেলর নিয়োগে যোগ্যতার ভিত্তিতে দুজন করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ সেবা দেওয়ার কথা ছিল।
পরিবারে সিজোফ্রেনিয়া, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি থাকলে, ক্যানসার, পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী বা এ ধরনের সদস্য থাকলে ওই পরিবারের সদস্য এবং পরিচর্যাকারীদের কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য কমিউনিটিভিত্তিক মনঃসামাজিক কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করার কথা ছিল কমিউনিটির সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের।
দুর্ঘটনায় পরিবারের কোনো সদস্যের আকস্মিক মৃত্যু হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের খাপ খাওয়াতে সমস্যা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তা, হাসপাতালের সমাজসেবা কর্মকর্তা এবং ধর্মীয় নেতাদের শোক প্রশমন কাউন্সেলিংবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ছিল।
গৃহকর্মীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, বিজ্ঞাপনের সেন্সর বোর্ডে, প্রতিরক্ষা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যালয় এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ব্যক্তিগত এবং দলীয় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে কমপক্ষে একজন করে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নিয়োগ করা হবে।
হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেন্টার, বার্ন ইউনিটে কর্মরতদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি মানসিক চাপ কমানোর জন্য কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এতিমখানা, আবাসিক হোস্টেল, বৃদ্ধনিবাস, কারাগার, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চালক এবং মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে কেউ যাতে এ সেবা থেকে বাদ না পড়ে, নীতিমালার খসড়ায় তা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
নীতিমালার খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইসমত জাহান। তিনি ২০০৯ সালে ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার চালুর সময় থেকেই সেন্টারে কাজ করছেন। বর্তমানে সেন্টারের প্রধান ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইসমত জাহান বলেন, মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় খসড়াটি আর চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। নারী, শিশুসহ সবার সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশের কথা চিন্তা করেই নীতিমালাটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়েই আচরণগত সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে মানসিক জটিলতা কমানোর কথা বলা হয়েছিল। নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ত। ফলে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে দৌড়ানো কমত।