পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রে রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষজন ফানুস উড়িয়ে প্রবারণা উৎসব পালন করেন। রোববার সন্ধ্যায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি কলাপাড়া: সন্ধ্যার আকাশে এ যেন ‘তারা’র মেলা। দু-একটি হঠাৎ হঠাৎ মাটিতেও খসে পড়ছে। খসে পড়া এসব ‘তারা’ আসলে আকাশে ওড়ানো একেকটি ফানুস। এ দৃশ্য পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রবারণা উৎসবের। আজ রোববার সন্ধ্যার পর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটার আকাশ প্রবারণা উৎসবের ফানুসে ঢেকে যায়।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিন মাসের বর্ষাবাস সমাপনীতে প্রবারণা পূর্ণিমা উদ্যাপন করেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা। বুদ্ধপূজা, সংঘদান, পিণ্ডদান, অষ্টপরিষ্কার দান, পঞ্চশীল প্রার্থনা, শীল গ্রহণ, প্রদীপপূজা ও ফানুস ওড়ানোর মতো নানা আচার পালন করা হয় প্রবারণা পূর্ণিমায়।
আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তিন মাসের জন্য বর্ষাবাস শুরু করেন, যা আশ্বিনী পূর্ণিমায় অর্থাৎ আজ শেষ হচ্ছে। আগামীকাল সোমবার কঠিন চীবরদান শুরু হবে। আজ থেকে শুরু হওয়া রাখাইনদের উৎসব শেষ হবে মঙ্গলবার।
কুয়াকাটার পাশাপাশি গোড়া আমখোলাপাড়া, কেরানীপাড়া, কালাচানপাড়া, বৌলতলীপাড়া, হাঁড়িপাড়া, বেতকাটাপাড়া, নাচনাপাড়াসহ উপজেলার ২৮টি রাখাইন পাড়ায় আজ ফানুস উড়িয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন। চমৎকার এ দৃশ্য দেখতে ভিড় করে শত শত মানুষ। এ ছাড়া আজ প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে মোমবাতি প্রজ্বালন, ঘণ্টা বাজানো, পঞ্চমশীল অনুষ্ঠান, পূজা–অর্চনা ও ধর্মীয় আলোচনা হয়। তবে উৎসবের প্রধান আকর্ষণ এ ফানুস ওড়ানো।
রাখাইনদের প্রবারণা উৎসব প্রাণবন্ত করতে কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন প্রতিটি রাখাইন পাড়ার নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, এক সপ্তাহ আগে থেকেই তাঁদের সম্প্রদায়ের তরুণ-যুবকেরা ফানুস তৈরির কাজ শুরু করেন। প্যারাসুট ফানুস, মালা ফানুস, লেস ফানুস—হরেক নামের ফানুস একেকটি তৈরি করতে তাঁদের দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে রাখাইন পল্লির প্রতিটি বৌদ্ধমন্দির সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। অতিথি আপ্যায়নের খাবারের তালিকায় রয়েছে কুকি, পাটিসাপটা, পাতাপিঠা, বিন্নি চালের পিঠা, নারকেল ও চিনি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের ভাত, ক্ষীর ও পায়েস। রাখাইনরা তাঁদের মন্দির ও গৃহে আসা নিজ সম্প্রদায়সহ অন্য ধর্মাবলম্বী অতিথিদের এসব খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করছেন।
পটুয়াখালী কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহারের সাবেক সভাপতি ও রাখাইন অধিকার আন্দোলনের প্রবীণ সংগঠক লুফ্রু মাস্টার বলেন, এ পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। যার কারণে এ দিনটিতে নানা ধর্মীয় কার্য সম্পাদন ও রাতের আকাশ আলোকিত করতে ফানুস ওড়ানো হয়। মূলত প্রবারণা পূর্ণিমার রাতে আকাশবাতি বা ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে গৌতম বুদ্ধের অহিংসার বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখ-শান্তি আর কল্যাণ কামনা করেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ।
মিশ্রিপাড়া সীমা বৌদ্ধবিহারের ভিক্ষু ও গৌতম বুদ্ধ পাঠাগারের গবেষক উত্তম ভিক্ষু বলেন, ‘আমাদের এ উৎসব কালের বিবর্তনে সর্বজনীনতার রূপ লাভ করেছে।’
বাংলাদেশ বৌদ্ধ-কৃষ্টি প্রচার সংঘের পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার সভাপতি নিউ নিউ খেইন বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের পাড়াভিত্তিক লোকজন ক্রমে কমে যাচ্ছে। এখন যাঁরাও আছেন, তাঁদের আর্থিক অসচ্ছলতাসহ নানা সংকট তো রয়েছেই। প্রবারণা উৎসব পালনে সরকারি পর্যায় থেকে যা সহায়তা দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। যার কারণে প্রবারণা উৎসবে ফানুস ওড়ানো আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। তারপরও ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে যে যতটুকু পারছেন, ততটুকু করে উৎসব পালন করার চেষ্টা করছেন।’
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, প্রতিটি রাখাইন পাড়ায় প্রবারণা উৎসব পালন করার জন্য ৫০০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। রাখাইনরা যাতে এ উৎসব ভালোভাবে পালন করতে পারে, সে জন্য সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।