লক্ষ্মীপূজার আয়োজন করছেন এক নারী | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: রোববার সারা দেশে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে আয়োজন করা হচ্ছে লক্ষ্মীপূজার। সামর্থ্য অনুযায়ী শাড়ি, ধুতি, গামছা, তুলসী, ধান, চিরুনি, পান-সুপারি, নাড়ু, লুচি, পায়েস, নানা রকম ফল, ঘিয়ের প্রদীপ, শঙ্খধ্বনিতে এ পূজা উদ্যাপন করা হচ্ছে। কেউ ছোট-বড় প্রতিমা বানিয়ে আবার কেউ সরাতে আঁকা ছবিতে এ পূজা করেন। এই পূজা ঘরে হয় বলে ঠাকুর কর্তা বা পুরোহিত পেতে সমস্যা হয়। পুরোহিতদের তুলনায় যজমানদের (যাঁদের বাড়িতে পূজা হয়) সংখ্যা বেশি থাকে। ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এতেও পুরোহিতদের সংখ্যাটা কমছে বলেই জানালেন বাড়িতে লক্ষ্মীপূজা আয়োজনকারীদের কয়েকজন।
বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব লক্ষ্মীপূজা। শারদীয় দুর্গোৎসব শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজা হয়। এই পূর্ণিমাকে বলা হয় কোজাগরী। সে জন্য এই পূজা কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা নামেও পরিচিত। পুরাণের তথ্য উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা জানালেন, কোজাগরী শব্দটি এসেছে ‘কো জাগর্তি’ থেকে, যার অর্থ ‘কে জেগে আছ’। পূর্ণিমার রাতে নাকি দেবী লক্ষ্মী জগৎ পরিক্রমায় বেরোন।
শাস্ত্রমতে, দেবী লক্ষ্মী ধনসম্পদ তথা ঐশ্বর্যের প্রতীক। উন্নতি, আলো, জ্ঞান, সৌভাগ্য, উর্বরতা, দানশীলতা, সাহস ও সৌন্দর্যের দেবী হিসেবে পরিচিত লক্ষ্মী। তাই লক্ষ্মী ঐশ্বর্যের দেবী। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, পূর্ণিমা রাতে দেবী লক্ষ্মী ধনধান্যে ভরিয়ে দিতে পূজা গ্রহণ করতে আসেন। সে কারণে বাঙালি হিন্দুদের ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপূজা হয়। বার্ষিক এই পূজা ছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার বাঙালি হিন্দুদের অনেক পরিবারে লক্ষ্মীপূজা হয়। তাই আর্থিক অবস্থা যা-ই থাকুক, প্রায় বেশির ভাগই চেষ্টা করেন বাড়িতে লক্ষ্মী পূজা করতে।
ঠাকুর বা পুরোহিত-সংকট প্রসঙ্গে রাজধানীর ব্যবসায়ী অসীম সাহা বলেন, পঞ্জিকা অনুযায়ী, গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ৪টা ১ মিনিট থেকে পূর্ণিমা তিথি শুরু হয়েছে। আজ রোববার দিবাগত রাত ২টা ৫৬ মিনিটে এই তিথি শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যেই লক্ষ্মীপূজা দিতে হবে। ফলে সময়ের একটা টানাটানি থাকে। এ ছাড়া গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি যেসব এলাকায় মন্দিরের সংখ্যা কম, সেসব এলাকায় ঠাকুরের সংখ্যাও কম। একেক বাড়িতে পূজা সম্পন্ন করতে ঠাকুরের ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লেগে যাচ্ছে।
অসীম সাহা জানালেন, তিনি সব সময় যে ঠাকুরকে দিয়ে পূজা দেন তিনি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ফলে অন্য ঠাকুর আনতে হয়েছে। এই ঠাকুর রাত সাড়ে আটটা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত সময় দিয়েছেন।
লক্ষ্মীপূজায় হিন্দু নারীদের অনেকেই উপবাস করেন। পূজা অর্চনার পাশাপাশি ঘরবাড়ির আঙিনায় লক্ষ্মীর পায়ের ছাপের আলপনা আঁকা হয়। সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। সাধারণত ঘরোয়া পরিবেশে লক্ষ্মীপূজায় বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।
অসীম সাহার মতে, প্রদীপ জ্বালানো, আলোকসজ্জা—এগুলোর সঙ্গে সৌন্দর্যের যোগ আছে। একইভাবে মনে করা হয়, যেখানে আলো আছে সেখানে অশুভ কিছু থাকতে পারে না। তিনি জানালেন, নারীরা উপবাস ভেঙে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়বেন। তারপর পূজা সম্পন্ন হবে।
ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীকে বিশ্বের নানা অঞ্চলে নানাভাবে পূজা করা হয়। বাঙালি বিশ্বাসে লক্ষ্মী দেবী দ্বিভুজা ও তাঁর বাহন প্যাঁচা এবং হাতে থাকে শস্যের ভান্ডার। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি হিন্দু সমাজে রাজা-মহারাজা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ গৃহস্থ পর্যন্ত সবাই লক্ষ্মী দেবীর পূজা করে আসছেন।
বেসরকারি চাকরিজীবী রাকেশ সাহাও জানালেন, লক্ষ্মীপূজাটা বেশির ভাগই সন্ধ্যার পরে দিতে চান। এ কারণেও ঠাকুরের সংকট লেগে যায়। আর ব্রাহ্মণের ছেলে পড়াশোনা শেষ করে এখন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
রাজধানীতে একা হাতে ঘরে পূজার আয়োজন করা কষ্টসাধ্য বলে অনেকেই লক্ষ্মীপূজা দিচ্ছেন না। তবে পূজার জন্য পদ্মফুল বা আনুষঙ্গিক যা লাগে, তা রাজধানীর শাঁখারীবাজারসহ পুরান ঢাকায় খুব সহজেই পাওয়া যায় বলে সংশ্লিষ্টরা জানালেন। ঢাকার বাইরে বরং এসব উপকরণ পাওয়া কষ্টকর হয়ে গেছে।
উন্নয়নকর্মী জয়ন্ত কুমার জানালেন, পূজার ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তনও এসেছে।
নেত্রকোনার পল্লব চক্রবর্তী কাব্য ও ব্যাকরণ তীর্থের ছয় বছরের কোর্স করেছেন। তবে পুরোহিত পেশায় আসেননি, সাংবাদিকতা করছেন। একইভাবে তাঁর আরেক ভাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের বাবা কণক চক্রবর্তী বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে একজন বড় পণ্ডিত। দাদা, বাবা একসময় পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেছেন। ৭৫ বছর বয়সী বাবা এবার বাড়ির লক্ষ্মীপূজায় পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করবেন।
পল্লব চক্রবর্তী জানালেন, তাঁর এক চাচা কালীপ্রদ স্মৃতিতীর্থ বড় পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর পাঁচ ছেলের মধ্যে মাত্র একজন পুরোহিত হয়েছেন। পল্লব চক্রবর্তীর মতে, পুরোহিতের পেশায় আগের সেই সম্মানটা নেই। এখন যাঁরা চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁরাই এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন। তাই পুরোহিতের সংখ্যা কমছে।