রওশনকে কঠোর বার্তা, সমঝোতার পথ খুঁজছে দুই পক্ষ

রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের |  ছবি: সংগৃহীত

আমানউল্লাহ আমান: জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে কঠোর বার্তা দিতে চায় দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম। আর এ জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এরশাদের ভাগনে ও দলের যুগ্ম মহাসচিব সংসদ সদস্য আদেলুর রহমান আদেলকে। আগামী ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির নামে ডাকা সম্মেলন প্রত্যাহার না করলে প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হতে পারে রওশনকে।

তবে রওশনপন্থিদের দাবি, রওশন এরশাদ চান না দলে বিদ্রোহ হোক। তিনি চান যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে সবাইকে নিয়ে দলকে শক্তিশালী করে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে। আর এই কারণেই সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন। রওশন এরশাদ দেশে ফিরলেই সবাইকে নিয়ে বিষয়টি সমাধান করবেন বলে আশা তাদের।

জাতীয় পার্টির সূত্রে জানা গেছে, প্রকাশ্যে যাই আসুক না কেন পর্দার অন্তরালে দেবর-ভাবির সমঝোতার চেষ্টা চলছে। তার অংশ হিসেবে অব্যাহতি দেয়া নেতাদের দলে ফেরাতে বলেছেন রওশন। জি এম কাদের নিজের অবস্থানে অনড়। এরই মধ্যে রওশনপন্থিরা ১০ জেলায় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করেছেন। জি এম কাদেরপন্থিরা তিন নেতাকে অব্যাহতি ও দুজনকে দিয়েছেন কারণ দর্শানোর নোটিশ। রওশনপন্থিদের চাওয়া সম্মেলনের চাপ দিয়ে ঐক্যের জন্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে এগিয়ে আনা। শৃঙ্খলার নামে রওশনপন্থিদের দলের বাইরে রাখাই জি এম কাদেরপন্থিদের প্রধান কৌশল। সমঝোতার পথ খুঁজছে উভয়পক্ষই।

রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে শনিবার দলটির প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভা হয়। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই যৌথ সভায় প্রেসিডিয়ামের ৪১ সদস্যের মধ্যে ৩৮ জন এবং ২৬ সংসদ সদস্যের মধ্যে ২০ জন উপস্থিত ছিলেন। পীর ফজলুর রহমান দেশের বাইরে এবং সেলিম ওসমান ও ডা. রুস্তম আলী ফরাজী অসুস্থ থাকায় সভায় যোগ দিতে পারেননি। অনুপস্থিত বাকি তিন সংসদ সদস্য হলেন রওশন এরশাদ, মসিউর রহমান রাঙ্গা ও সাদ এরশাদ।

সভায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, পার্টির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না তিনি যত বড় বা শক্তিশালী হোন না কেন। দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় যেকোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। 

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটন  বলেন, দলের শৃঙ্খলার বিষয়ে চেয়ারম্যানকে আরও কঠোর হওয়ার সুপারিশ করেছেন প্রেসিডিয়াম সদস্যরা। মসিউর রহমান রাঙ্গাকে স্থায়ী বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, দলের গঠনতন্ত্র ভঙ্গ করে রওশন এরশাদের নামে আগামী ২৬ নভেম্বর যে সম্মেলন ডাকা হয়েছে তা বাতিল করতে শেষবারের মতো রওশন এরশাদকে অনুরোধ করা হবে। অনুরোধ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব সংসদ সদস্য আদেলুর রহমান আদেলকে। রওশন যদি সম্মেলন নিয়ে অনড় থাকেন তাহলে তাকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।

সভায় জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আমি ম্যাডামকে (রওশন এরশাদ) কিছুদিন আগে মোবাইলে বলেছিলাম, আপনি আমাদের মাতৃসমতুল্য। আমি সব সময় আপনার সঙ্গে ছিলাম, আপনি কাউন্সিল প্রত্যাহার করুন। তিনি আমাকে ভালো-মন্দ কিছু বলেননি। এরপর একাধিকবার ফোন করলেও ফোন ধরেননি। পার্টিতে যেই বিভেদ সৃষ্টি করবে সে আমার আপন ভাই হলেও তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সভা সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পার্টি থেকে কিছুদিন আগে অব্যাহতি পাওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের সাধারণ সদস্য পদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

সভার সিদ্ধান্তমতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনকে পরীক্ষামূলক হিসেবে পর্যবেক্ষণ করবে দলটি। সভায় দলটির নেতারা বলেন, সংসদ নির্বাচন অনেক দূরে, সিদ্ধান্ত নেয়ার অনেক সময় আছে। ইভিএম বিষয়ে জাতীয় পার্টির আপত্তিকে নির্বাচন কমিশন কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সে বিষয়টিও দেখতে চান তারা। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে জোটের বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে সভায় উপস্থিত একাধিক নেতা জানান।

যৌথ সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টি মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভক্তি নেই, জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ। এখন জাতীয় পার্টির কোনো কাউন্সিল হচ্ছে না, জাতীয় পার্টির কাউন্সিলের সময় এখনো হয়নি। কিছু মানুষ একটি কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির নাম ব্যবহার করছে। আসলে ওই কাউন্সিলের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা ওই কাউন্সিলকে আমলেই নিচ্ছি না। সবাই জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এখন বিরোধীদলীয় নেতা। জাতীয় পার্টি সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই সংসদে যাবেন।

তিনি বলেন, বেগম রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক, এটি অলংকারিক পদ। কাউন্সিল আহ্বান করার এখতিয়ার নেই তার। দলীয় বা প্রশাসনিক আর কোনো দায়িত্ব নেই বেগম রওশন এরশাদের। নৈতিকতার প্রশ্নেই দেশে ফিরে বেগম রওশন এরশাদের বিরোধীদলীয় নেতার পতাকা ব্যবহার করা উচিত নয়।

কারণ, সংসদীয় দলের সদস্যরা গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত করেছেন। আর মসিউর রহমান রাঙ্গা নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন তিনি জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি করবেন না। তাই তার বিরোধীদলীয় হুইপের পদে থাকার প্রশ্নই আসে না।

জাতীয় পার্টির জি এম কাদেরপন্থিদের দাবি, ছেলে সাদ এরশাদ ও রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন রওশন এরশাদ। রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে জি এম কাদরকে কিছু নাম দেয়া হয়েছিল দলে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু জি এম কাদের তাদের দলে ফেরাননি। সেই জন্যই নিজের অবস্থানে অনড় আছেন রওশন। ওই নেতাদের মধ্যে তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ, ছেলে সাদ এরশাদ, কাজী মামুনুর রশীদ ও আব্দুস সাত্তারের নাম রয়েছে। একই সঙ্গে মসিউর রহমান রাঙ্গাকেও দলে ফেরাতে বলেছিলেন রওশন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য  বলেন, ‘যাদের দলে ফেরাতে রওশন নাম দিয়েছেন তাদের মধ্যে কাজী মামুনুর রশীদকে ফেরানোর বিষয়ে চেয়ারম্যান ইতিবাচক। আব্দুস সাত্তার ভালো লোক। তাকে হয়তো দলে ফিরিয়েও নিতে পারেন। আরও যে কয়েকজনের নাম দেয়া হয়েছে তারা কেউ গুরুত্বপূর্ণ নন। জাতীয় পার্টিতে চেয়ারম্যানই দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ফলে তাদের ফিরিয়ে নিয়েও তেমন কোনো অসুবিধা আমি দেখি না।’

পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, বর্তমানে রওশনের সঙ্গে আছেন গোলাম মসীহ ও কাজী মামুনুর রশীদ। তারা কিছুই করতে পারবেন না, যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা না পান। এখন রওশন এরশাদ দেশে ফেরার পর সরকার যদি তাদের সহযোগিতা করে তাহলে এখন যারা জি এম কাদেরের সঙ্গে আছেন তাদের কেউ কেউ রওশন এরশাদের সঙ্গে গিয়ে ভিড়তে পারেন।