জৌলুস হারাচ্ছে পুরান ঢাকা

পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে ২০০ থেকে ৩০০ বছরের পুরোনো বাড়ি আছে।  সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার পুরনোতম অংশ, নাম তাই পুরান ঢাকা। কিন্তু নতুন ঢাকার সঙ্গে বয়সের তুলনায় যদি না-ও যান, তবু একে যথেষ্ট ‘পুরান’ই বলতে হবে। চার শ’ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ এলাকাকে ‘পুরান’ মানা ছাড়া উপায়-ই বা কী! কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে পুরান ঢাকার স্থাপনাগুলো যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি হারাতে বসেছে তার সোনালি ইতিহাসের গল্পগুলোও। অথচ এককালের শতবর্ষের পুরনো একতলা- দোতলা ভবন, ঘিঞ্জি অলিগলি, রাস্তার পাশে হোটেল-রেস্টুরেন্টে হাই ভলিউমে বাংলা-হিন্দি জনপ্রিয় গান   বাজানো পুরান ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সবকিছুই যেন গলা উঁচিয়ে জানান দেয় তার অতীত জৌলুসের কথা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পুরান ঢাকার রূপ বদলাচ্ছে! 

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের বাহন হল রিকশা। রিক্সা তিন চাকার এক রঙ বেরঙের যান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সরজমিন দেখা যায়, পুরান ঢাকার লালবাগের শেখ সাহেববাজার, হরনাথ ঘোষ রোড, লালবাগ কেল্লার মোড়, খাজে দেওয়ান লেন, চকবাজার, জেলখানা রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় ইট-সুরকির তৈরি পুরনো বাড়িঘর ভেঙে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট, শপিংমল, কমিউনিটি সেন্টার ও মার্কেট নির্মিত হচ্ছে।  

একসময় ঘোড়া ও পরবর্তীতে রিকশাই ছিল এ এলাকার প্রধান যানবাহন। কিন্তু বর্তমানে পাড়া-মহল্লার সরু অলিগলিতেও দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি দিনভর ছুটে চলতে দেখা যায়। পুরান ঢাকাবাসীর পুরি, শিঙ্গাড়া ও বাকরখানি জাতীয় খাবার একসময় ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার পছন্দের তালিকায় থাকলেও বর্তমানে গুলশান ও বনানীর মতো নামিদামি ফাস্টফুডের দোকান গড়ে উঠছে। বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত কমিউনিটি সেন্টার কোনো অংশেই নতুন ঢাকার কমিউনিটি সেন্টারের মানের চেয়ে কম নয়। অন্যদিকে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় প্রহ্লাদ বাবুর সেই দুঃখিনী মার্চের বিউটি বোর্ডিং-এ আগের মতো হৈ-হুল্লোড়-আড্ডার চিত্র দেখা মেলে না। 

 পুরনো বাড়িঘর ভেঙে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট হচ্ছে।  হরনাথ ঘোষ রোড। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

৫৫ বছরের বৃদ্ধ আমিনুল ইসলাম। ফরাশগঞ্জ এলাকায় দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘পুরান ঢাকা আর পুরান ঢাকা নাই। সব বদলাইয়া যাইতাছে। একসময় একতলা-দোতলার বেশি বড় বাড়ি দেখা যেতো না। মহল্লার সবাই সবাইকে চিনতো কিন্তু এখন পুরান সব বাড়িঘর ভেঙে নতুন নতুন বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট হচ্ছে। কেউ কাউরে চেনে না। মানুষের সম্পর্কে চিড় ধরেছে।’

পুরান ঢাকার খাবারের দোকান  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

মুজাহিদ বিল্লাহ নামে এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, ‘পুরান ঢাকার মানুষের কাছে আগে নাস্তায় ডাল-পুরি, শিঙ্গাড়া, চা ও বিরিয়ানি খুব বেশি প্রিয় তালিকায় থাকলেও বর্তমানে এসবের প্রতি মানুষের বিশেষ করে তরুণদের কাছে কদর নেই। তারা ফাস্টফুড ও চাইনিজ এবং নামিদামি ব্র্যান্ড দোকানের খাবার খেতে চায়।’ 

শাঁখারী বাজারের একটি দোকানে লাল নীল সবুজ সাদা বেগুনী হরেক রঙের ঘুড়ি ঝুলতে দেখা যায়  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

শাঁখারী বাজারের ব্যবসায়ী শঙ্খ শ্রী ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী তারক রায় বলেন, ‘পুরান ঢাকার পোলাপাইন আগের মতো আর ছাদে ঘুড়ি উড়ায় না। বল নিয়ে মাঠে ছুটে যায় না। সারাদিন কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে।’ আধুনিক প্রযুক্তি পুরান ঢাকার মানুষকে বন্দি জীবনে অভ্যস্ত করে ফেলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। 

পুরান ঢাকার রাজপথে চলছে ঘোড়ায় টানা গাড়ি টমটম | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সিদ্দিক বাজার এলাকার টমটমের মালিক সালাহউদ্দিন বলেন, ‘ঘোড়ার গাড়ি আমাগো আদি পুরান ঢাকাইয়াবাসীর ঐতিহ্য। আগের মতো ঘোড়া ঢাকায় নেই।  এখন রাস্তায় যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি চালানোটাই কষ্ট। অন্যদিকে ঘোড়ার সঠিক পরিচর্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। ভুসি, ঘাস অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর দাম বাড়ায় খরচ অনেক বেড়েছে। এখন আর ঘোড়াকে তিনবেলা খাবার দেয়া সম্ভব হয় না।’

বানরকে খাবার দেওয়া হচ্ছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

কালের বিবর্তনে পুরান ঢাকায় বানরের বিলুপ্তির কথা জানালেন সূত্রাপুরের বানিয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জলি বেগম। তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকায় মূলত রেসাস ম্যাকাক প্রজাতির বানর বাস করে। উন্নত বিশ্বে এ প্রজাতির বানর গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়। মারা যাওয়ার পাশাপাশি পাচারের কারণেও বিলুপ্ত হচ্ছে এই বানরগুলো। অনেকে বানরের ছোট বাচ্চা আটকে রেখে বিক্রি করে দেয়। ফলে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বহন করা এই বানরের দল।’  

পুরান ঢাকার শ্রীশ দাস লেনের হলুদ রঙের দোতলা ১ নম্বর বাড়িটি। এই বাড়িটিতে ৫০-৬০ দশকে জমে উঠত কবি সাহিত্যিক লেখকদের আড্ডার পশরা; চলত শিল্প ও সাহিত্যের চর্চাও। রাজনীতিক চর্চাও কম হত না | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

একান্ত আলাপচারিতায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংয়ের পরিচালক সমর সাহা বললেন, ‘ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। কবি-সাহিত্যিকরা এখন খুব কম আসেন। ব্যবসাটা কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সেটাই ভাবছি। এখন আর বিউটি বোর্ডিং-এ আগের মতো আড্ডার চিত্র দেখা মেলে না।’