সম্প্রতি কুমিল্লার নিখোঁজ সাত শিক্ষার্থী | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: জঙ্গিবাদে প্রভাবিত হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন বয়সের
কিশোর-তরুণরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তথাকথিত জিহাদের নামে! এই সন্দেহ
থেকে তদন্তে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার
সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ১৫ থেকে ৩০
বছর বয়সী প্রায় ৫০ জন নিখোঁজ হয়েছে। বাসা থেকে বের হয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে
তারা। এই তরুণদের নিখোঁজের পেছনে কারা জড়িত তাদের শনাক্ত করতে কাজ করছেন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অচিরেই নিখোঁজ তরুণদের সন্ধান এবং এর পেছনের কুশীলবদের
আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সন্তান
নিখোঁজ হয়েছে এমন পরিবারগুলো বলছে, শঙ্কা নিয়ে দিন কাটছে তাদের। কিশোর ও
তরুণরা বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের ঠেলে দিয়েছে
কাঠগড়ায়। এত কম বয়সে জঙ্গিবাদের মতো অপরাধে যদি তারা জড়িয়ে থাকে,
তাহলে তা নিয়ে বিব্রত হতে হবে পুরো পরিবারকে।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর
পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে ৫০ জন তরুণ নিখোঁজের
তথ্য জানান। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে জঙ্গি হামলার আশঙ্কার কথাও
বলেন। তিনি বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাকে
কেন্দ্র করে এসব নিখোঁজ তরুণের অনেকেই ট্রেনিং করছে। এগুলোর ব্যাপারেও
খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, বিভিন্ন জঙ্গি
সংগঠনের সদস্যরা তরুণদের দলে ভিড়ানোর জন্য অনলাইনে চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন
ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি
দেওয়ার চেষ্টা করলেও অনেকেই ধরা পড়ছে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার জন্য
তারা ব্যবহার করছে নানা ধরনের এনক্রিপটেড অ্যাপ। যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব এনক্রিপটেড
অ্যাপ নিজেদের সিকিউরিটির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করায় অন্য কাউকে
তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এ কারণে কে কোন ধরনের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা
কিংবা আলাপ আলোচনা করছে, তা অন্তরালে থেকে যায়।
আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, নাশকতা ছড়ানোর লক্ষ্যেই ঘর থেকে
বেরিয়ে গেছে এসব তরুণ। কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেট, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন
এলাকা থেকে কিশোর ও তরুণ নিখোঁজের খবর আমরা পেয়েছি। দেশের বিভিন্ন জায়গা
থেকে যেসব তরুণ নিখোঁজ হয়েছে সেসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের
অবস্থান শনাক্ত করে উদ্ধার করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। বিভিন্ন
তথ্য পর্যালোচনা এবং বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ
করে যাচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনও তথ্য পাওয়া
যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জে কাউকে না
বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় নবম শ্রেণির ছাত্র সিয়াসাত রায়হান। এই ঘটনায়
গত ২৪ মার্চ একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি)করা হয় সেই কিশোরের পরিবারের পক্ষ
থেকে। কেরানীগঞ্জে একটি মাদ্রাসার সামনে আরও দুই সমবয়সীর সঙ্গে গত মাসের
১৮ তারিখ দেখা যায় তাকে। পরে সেই মাদ্রাসার সামনে থেকে বেরিয়ে চলে যায়
তিন জন। এ সময় রায়হানের সঙ্গে থাকা দুই জনের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একজন পটুয়াখালীর আলামিন ও মিরাজ। আলামিন নিখোঁজ হয়
দুই মাস আগে। মিরাজ ঘর ছাড়ে কোরবানি ঈদের পর।
নিখোঁজ কিশোর
রিয়াসাত রায়হানের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার বাবা তানজীম
মোহাম্মদ বলেন, ১৫ বছর বয়সী রায়হান বাসা থেকে বের হওয়ার
আগে কোনও কিছুই আঁচ করতে পারেনি তারা। তবে ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার পর
তার রেজাল্ট খারাপ হয়। এ নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে তর্কবিতর্ক হয় তার। তবে
ওই ছেলের বাবা বলছে, তার ছেলে কীভাবে অন্য একটি জগতে পা বাড়ালো কখনও
বুঝতে পারেনি তারা। যারা তার ছেলেকে এভাবে মোটিভেট করেছে তারা অবশ্যই
বয়স্ক। তিনি তার সন্তানকে ফিরে পেতে চান।
সম্প্রতি রাজধানীর বনশ্রী
থেকে এক চিকিৎসককে গ্রেফতারের পর কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড
ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, কুমিল্লা থেকে
সাত কিশোর ও তরুণের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ইন্ধন রয়েছে ওই চিকিৎসকের।
জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছে থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী
কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন। নিখোঁজদের অবস্থান শনাক্ত করে তাদের উদ্ধারে
অভিযান চলমান রয়েছে।
এত বিপুল সংখ্যক কিশোর ও তরুণ নিখোঁজের ঘটনা
জঙ্গিবাদ উত্থানের জন্য আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর
জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত আব্দুর রশিদ বলেন, প্রতিনিয়ত কথিত
হিজরতের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে। এর
পেছনে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ
ধরনের ঘটনা সমাজের জন্য কী ধরনের বার্তা দেয়- এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ৫০ জন তরুণ বাসা থেকে বের হয়ে গেছে, তাদের খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছে না। কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে তারা পাড়ি দিয়েছে। তারা কোথায় আছে,
তাদের অবস্থান কোথায়, ঠিকানা কিংবা তাদের বিবরণও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন
পর্যন্ত জানতে পারছে না। এটা স্পষ্ট তারা উগ্র ধর্মীয় মতবাদ দ্বারা
প্রভাবিত হয়ে প্রশিক্ষণ কিংবা অভিযান পরিচালনা করার জন্য ঘর থেকে
বেরিয়েছে। আমাদের দেশে যেসব অশুভ শক্তির পাঁয়তারা এবং তাদের যেসব
কার্যক্রম, বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসব পালনের সময়ে দুর্গাপূজা কেন্দ্রিক
নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর
মধ্যে অনাস্থা তৈরি হয়। যার ফলশ্রুতিতে কোনও কোনও রাজনৈতিক দল এসব উগ্র
জঙ্গি মতাদর্শ উসকে দেয়।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড
ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিখোঁজ কিশোর ও তরুণদের অবস্থান
শনাক্ত করে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। কারা তাদের নিয়ে গেছে, কাদের
ইন্ধন রয়েছে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।
মাস্টারমাইন্ড রিক্রুটারদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। তদন্ত অনেক দূর
এগিয়েছে বলেও জানান তিনি।