মানবাধিকার সুরক্ষার অঙ্গীকার সরকারের

জাতিসংঘ | ফাইল ছবি

কামাল আহমেদ, লন্ডন থেকে: বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচনের জন্য সব রকম মানবাধিকারের সুরক্ষা ও প্রসারে সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্যদের কাছে একটি অঙ্গীকারপত্র দিয়েছে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির কাছে ১৪ সেপ্টেম্বর কূটনৈতিক পত্রের সঙ্গে অঙ্গীকারনামাটি পাঠান। গত আগস্টে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত সরকারের আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন তিনি মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরেছিলেন।

এর এক মাস পর বাংলাদেশ যে অঙ্গীকারনামা দিয়েছে, তাতে ব্যাশেলেতের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের কোনো প্রতিফলন নেই। এমনকি অঙ্গীকারনামায় মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁর দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদের জন্য ১৪টি শূন্য আসন পূরণে আগামী ১১ অক্টোবর সাধারণ পরিষদে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। অঞ্চল ভিত্তিতে ভাগ করা এশিয়া ও প্রশান্ত-মহাসাগরীয় এলাকার চারটি আসন শূন্য হচ্ছে। এসব আসনে বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলো আফগানিস্তান, বাহরাইন, কিরগিজস্তান, মালদ্বীপ, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনাম।

দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে মানবাধিকারের সুরক্ষা ও প্রসারে বাংলাদেশ কী কী করবে, তার বিশদ বিবরণ রয়েছে ৯ পৃষ্ঠার এই অঙ্গীকারনামায়। বাংলাদেশের সংবিধান দেশের ১৬ কোটি মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষার কেন্দ্রে রয়েছে উল্লেখ করে সরকার ব্যক্তিস্বাধীনতা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারসহ বিভিন্ন অধিকার সুরক্ষায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা এতে বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কী কী করা হবে, তা–ও কিছুটা নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে।

মানবাধিকারের সুরক্ষা ও প্রসারে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তর ও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে সরকার সহযোগিতা করে আসছে দাবি করে বলা হয়েছে, এ ধরনের সহযোগিতা বাড়ানো ও জোরদার করা হবে। তবে আন্তর্জাতিক পরিসরে কী ভূমিকা নেওয়া হবে, সে বিষয়ে এ সহযোগিতার কথা বলতে গিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৪ সেপ্টেম্বর পাঠানো অঙ্গীকারনামায় এমন বক্তব্যে স্পষ্টতই বোঝা যায় তা হালনাগাদ করা হয়নি। কারণ, গত আগস্টে ব্যাশেলেত বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।

মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ কী কী করেছে, তার বিবরণ দিতে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মানবাধিকারের নয়টি প্রধান সনদের আটটি অনুমোদন করেছে। ওই সব সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোয় নিয়মিত প্রতিবেদন পেশের মাধ্যমে জানিয়ে আসছে।

ওই নয়টি সনদের মধ্যে বাংলাদেশ যেটি এখনো গ্রহণ করেনি, সেটি হচ্ছে গুম থেকে সব নাগরিকের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে। মিশেল ব্যাশেলেত তাঁর সফর শেষের বিবৃতিতে ওই সনদ অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পরে মানবাধিকার পরিষদের সভায়ও ওই একই আহ্বান জানানো হয়। তাঁরা একই সঙ্গে গুমের অভিযোগগুলোর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচার সম্পন্ন করার সুপারিশও করে আসছেন। সরকার অবশ্য এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এসেছে এবং সাধারণ পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া অঙ্গীকারনামাতেও প্রসঙ্গটির কোনো উল্লেখ নেই।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা স্বাধীনভাবে নাগরিকদের বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করছে বলে অঙ্গীকারনামায় জানানো হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দীর্ঘদিন পর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজ পরিচালনায় সাফল্যের দৃষ্টান্তও এতে তুলে ধরা হয়। আরও বলা হয় যে সুপ্রিম কোর্ট নাগরিক অধিকার রক্ষায় সক্রিয়ভাবে জনস্বার্থের মামলাগুলোতে আদেশ ও নির্দেশনা দিয়ে থাকে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে বলা হয়, দেশে শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত গণমাধ্যম রয়েছে। ৫৪৪টি দৈনিক, ৩৫৭টি সাপ্তাহিক, ৬২টি পাক্ষিক ও ৯৩টি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। ৩৩টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সচল আছে, যাতে সরকারের নীতি ও কার্যক্রম নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। করোনা মহামারির সময়ে সম্মুখসারির কর্মী হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকার স্বীকৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১১ লাখ ৮০ হাজার ডলারের সমান অর্থ বরাদ্দ করেছেন।

এ ক্ষেত্রেও মিশেল ব্যাশেলেতের বিবৃতিতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্বেগ ও সুপারিশ সম্পর্কে সরকারের হালনাগাদ অবস্থান অনুপস্থিত। ব্যাশেলেত ছাড়াও সংবাদমাধ্যমে স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে বিশ্বের এমন সব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অব্যাহত সংকোচন ও সাংবাদিক নিপীড়নের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে।

একইভাবে নাগরিক গোষ্ঠী বা এনজিওগুলোর কার্যক্রমের প্রসঙ্গে সরকার যে ভাষ্য দিয়েছে, তা হলো দেশে ৩ হাজার ৭৫টি বেসরকারি সংগঠন এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত এবং তারা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মানবাধিকারের সুরক্ষা ও প্রসারে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছে।

যদিও মিশেল ব্যাশেলেত তাঁর সফরের সময়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য কোনো বেসরকারি সংগঠনকে হয়রানি না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া বর্তমানে জেনেভায় চলমান মানবাধিকার পরিষদের সভায় গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি অধিকারের নিবন্ধন নবায়ন না করায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া সরকারের বক্তব্যে এ বিষয়েও নতুন কিছু বলা হয়নি।

মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ারদের সঙ্গে সরকার সহযোগিতা করে আসছে বলেও অঙ্গীকারনামায় দাবি করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সফর করেছেন যে দু-তিনজন, তাঁদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আরও যে ডজনখানেক স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার এবং গুম বিশেষজ্ঞদের কমিটির সদস্যদের সফরের অনুরোধের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট অঙ্গীকার এতে নেই।

সরকার আইনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে জানাতে গিয়ে সাক্ষ্য আইন সংশোধন করা হবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের কোনো অঙ্গীকার এতে নেই।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনে সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সঙ্গে কাজ করছে বলে বিভিন্ন সময় জানিয়েছে। মিশেল ব্যাশেলেতও এ বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও উপাত্ত সুরক্ষা আইনের বিষয়েও হাইকমিশনারের দপ্তর বিশদ সুপারিশমালা দিয়েছে। কিন্তু সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো অঙ্গীকার এতে নেই।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান, তাদের মানবিক সহায়তা ও বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও জাতিসংঘের তদন্তে বাংলাদেশ যেসব সহযোগিতা দিয়েছে, তা–ও অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে। ওই বিচারপ্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতেও সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে এ অঙ্গীকারনামায়।

সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে অবশ্য এ ধরনের অঙ্গীকারনামার চেয়ে কূটনীতির ভূমিকাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তবে অঙ্গীকারনামা মূলত কাজে লাগে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর, যারা এর ভিত্তিতে সরকারগুলোর কাছে জবাবদিহি চাইতে পারে। মানবাধিকার পরিষদ ও অন্যান্য সনদভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় এসব বেসরকারি সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।