ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) | ফাইল ছবি |
নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় প্রত্যেক ভোটারের আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিতে গেলে ভোটারের আঙুলের ছাপ আবার মেলানো হয়।
কারও আঙুলের ছাপ না মিললে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা নিজেদের আঙুলের ছাপ দিয়ে কোনো ভোটারকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন। তবে একজন কর্মকর্তা সর্বোচ্চ কতজন ভোটারের জন্য এই কাজটি করতে পারবেন, তা আইনে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে, নাকি উন্মুক্ত রাখা হবে—তা নিয়ে দোটানায় পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ইভিএমে প্রধানত দুটি অংশ। একটি হলো কন্ট্রোল ইউনিট (নিয়ন্ত্রণ অংশ), অন্যটি ব্যালট ইউনিট (যেখানে প্রার্থীর নাম ও প্রতীক থাকে)। ইভিএমে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটারের আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে বৈধ ভোটার শনাক্ত করা হয়। আঙুলের ছাপ মিললে ইভিএমের ব্যালট ইউনিট চালু হয়।
কিন্তু নানা কারণে অনেক ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলে না। সে ক্ষেত্রে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁর আঙুলের ছাপ দিয়ে ব্যালট ইউনিট চালু করে দেন। তারপর ভোটার গোপন কক্ষে গিয়ে ভোট দেন। এটি ‘ওভাররাইট’ (যদি কোনো ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলে, তখন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যেভাবে সংশ্লিষ্ট ভোটারকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেন) করার ক্ষমতা হিসেবে পরিচিত। তবে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করলে ভোটে কারচুপি করা সম্ভব বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে ভোটারের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সহাকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ইসির নির্ধারণ করা হারে ভোটারের জন্য ইভিএম ব্যালট ইস্যু (ব্যালট চালু) করতে পারবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুরুর দিকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোটারের জন্য এই সুযোগ করে দিতে পারতেন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা। এখন নির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্রের মোট ভোটারের ১ শতাংশ ভোটারের জন্য কাজটি করতে পারেন তাঁরা। প্রতিটি নির্বাচনের আগে পরিপত্র জারি করে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের এই ক্ষমতা দেয় ইসি। গত সেপ্টেম্বরে ঝিনাইদহ পৌরসভার নির্বাচন হয় ইভিএমে। তখন একটি পরিপত্র জারি করে ইসি বলেছিল, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোট ভোটারের ১ শতাংশ ভোটারকে শনাক্ত করে ইলেকট্রনিক ব্যালট ইস্যু করতে পারবেন।
ইসি সূত্র জানায়, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে এই ক্ষমতা কতটুকু দেওয়া হবে, তা আইনে সুনির্দিষ্ট করার চিন্তা করছে ইসি। এ জন্য জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) একটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ভোটারকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁর আঙুলের ছাপ দিয়ে ইলেকট্রনিক ব্যালট ইস্যু করতে পারবেন। গতকাল সোমবার কমিশনের সভায় প্রস্তাবটি তোলা হলেও তা নিয়ে আলোচনা হয়নি।
সূত্র জানায়, প্রস্তাবটির পক্ষে–বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন নির্বাচন কমিশনাররা। এর পক্ষের যুক্তি হলো—পদ্ধতিটি নিয়ে সমালোচনা ও সন্দেহ আছে। অনেকে বলে আসছেন, এর মাধ্যমে ভোট কারচুপির সুযোগ থাকে। সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যত খুশি ভোট দিতে পারেন। তাই আইনে এটি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হলে বিতর্ক কমবে।
অন্যদিকে এর বিপক্ষে যুক্তি হচ্ছে, সব ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব। যদি আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ভোটারকে এই সুযোগ দেওয়া যাবে, তাহলে সংকট তৈরি হতে পারে। যদি কোথাও ১ শতাংশের বেশি ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলার ঘটনা ঘটে, তখন সমস্যা দেখা দেবে। তাই আরেকটি বিকল্প নিয়েও ইসি চিন্তাভাবনা করছে।
তা হলো এই ক্ষমতা নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটারের জন্য সীমিত না করে উন্মুক্ত রাখা। যেখানে যতসংখ্যক ভোটারের জন্য প্রয়োজন হবে, ততজনের জন্যই কর্মকর্তারা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।
এ জন্য একটি আলাদা ফরম তৈরি করা হবে। তাতে কোন কোন ভোটারের জন্য কোন কোন কর্মকর্তারা নিজের আঙুলের ছাপ দিয়ে ব্যালট চালু করেছেন, তা লেখা থাকবে। ওই ফরমে প্রার্থীদের এজেন্টদেরও সই থাকবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ‘কোনো প্রকৃত ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে ওই ব্যক্তির জন্য প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ডিজিটাল ব্যালট ইউনিট চালু করে দিতে পারেন। কমিশন চায়, এই ক্ষমতার যাতে কোনো প্রকার অপব্যবহার না হয় এবং সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত থাকে। কীভাবে করলে এই উদ্দেশ্য পূরণ হবে, তা নিয়ে কমিশন আলাপ–আলোচনা করছে। এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
তবে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের দেওয়া এই ক্ষমতা উন্মুক্ত রাখা হলে বিতর্ক আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা আছে। গত আগস্ট মাসে ইভিএম নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত আলোচনা সভায় বলা হয়, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি আসনে জয়–পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ইভিএমে ‘ওভাররাইট’ করার অনুমতি ফলাফল পরিবর্তনের প্রধানতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
এ বিষয়ে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন যেটাই করুক, তাতে কোনো লাভ হবে না। কারণ, ইভিএম যন্ত্রটাই অগ্রহণযোগ্য ও দুর্বল যন্ত্র। কর্মকর্তাদের এই সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে অদৃশ্য কারসাজির সুযোগ থাকে। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, আস্থার সংকট। ইভিএমে মানুষের আস্থা নেই, ইসির ওপরও মানুষের আস্থা নেই। নির্বাচন কমিশন যেভাবে ইভিএমের সাফাই গাইছে, তাতে মানুষের অবিশ্বাস আরও বাড়ছে।