সাফ জয়ের পর শিরোপা নিয়ে ফটোসেশনে বাংলাদেশের মেয়েরা | ছবি: বাফুফে

বদিউজ্জামান, কাঠমান্ডু থেকে: হিমালয়ের দেশে সমুদ্র কোথায়? চারদিকে তো পাহাড়েই ঘেরা। কিন্তু কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামের ১৫ হাজার দর্শক যখন একসঙ্গে চিৎকার করে উঠছিলেন ‘নেপাল’, ‘নেপাল’ বলে, মনে হচ্ছিল যেন সাগরের গর্জন।

গ্যালারিতে ছিল মেক্সিকান ওয়েভ। ভুভুজেলা আর বাদ্যি বাজনার উন্মাদনায় যেন আকাশ ছুঁতে চাইলেন নেপালি দর্শকেরা। নেপালের পতাকা হাতে, ‘নেপাল’ লেখা টি-শার্ট পরে অনেকে ছবি তুললেন গ্যালারিতে। সবার হাতে ধরা মুঠোফোনের আলোয় যেন হাজারো জোনাকি জ্বলে উঠল স্টেডিয়ামে। কিন্তু নেপালিদের এমন উন্মাদনা পরিণত হলো শ্মশানের নীরবতায়। যেন ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলেন দর্শকেরা।

আসলে হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা এই বাংলাদেশকে থামানোর সাধ্য যে নেপালের ছিলই না। মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের অধরা ট্রফিটা অবশেষে জিতল বাংলাদেশ। ফাইনালে আজ স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়েছেন সাবিনারা। প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা যাচ্ছে বাংলাদেশের ঘরে। এমন দিনে, স্মরণীয় জয়ে শামসুন্নাহার করেছেন প্রথম গোল। পরের দুটি কৃষ্ণা রানী সরকারের। ২–০ হওয়ার পর নেপালের গোলটি করেন অনিতা বাসনেত। 

ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ৪৫ ধাপ এগিয়ে নেপাল। বাংলাদেশের র‌্যাঙ্কিং ১৪৭। নেপালের ১০২। অতীত পরিসংখ্যানও ছিল নেপালের পক্ষে। এর আগে বাংলাদেশ–নেপাল ৮ বারের সাক্ষাতে ৬ বার জয় নেপালের। ২ বার ড্র। আর ঘরের মাঠের দর্শকদের গগনবিদারী আওয়াজ তো ছিলই। কিন্তু কোনো কিছুই যেন আটকে রাখতে পারেনি বাংলাদেশের মেয়েদের।  

ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। আর এই বৃষ্টিতে মাঠ হয়ে যায় ভারী। কিন্তু এই ভারী মাঠেও ছন্দময় ফুটবল খেলেছেন মারিয়া, মনিকারা। যেন মারিয়াদের পায়ে ফুল হয়ে ফুটল ফুটবল।

ম্যাচের প্রথম মিনিটেই সুযোগ ছিল বাংলাদেশের গোল পাওয়ার। বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া মারিয়ার দূরপাল্লার শট নেপালের গোলরক্ষক আনজিলা সুব্বা আটকালেও পুরোপুরি গ্লাভসে জমাতে পারেননি। সিরাত জাহানের শট শেষ পর্যন্ত কর্নারের বিনিময়ে ফেরান আনজিলা। 

চোট নিয়েই আজ খেলতে নেমেছিলেন স্ট্রাইকার সিরাত জাহান। কিন্তু মাঠে নেমে তিনি বেশিক্ষণ খেলতে পারেননি। ব্যথায় কাতর সিরাতকে ১৩ মিনিটেই কোচ গোলাম রব্বানী তুলে নিতে বাধ্য হন। এরপর বদলি হিসেবে নামান শামসুন্নাহার জুনিয়রকে। কিন্তু কে জানত এই সুপার সাবই এগিয়ে নেবেন বাংলাদেশকে। শামসুন্নাহার নামতেই খেলার গতি বেড়েছে আরও।  

ম্যাচের ১৪ মিনিটে ডান প্রান্ত দিয়ে মনিকার বাড়ানো বলে দারুণ ফ্লিকে গোল করেন শামসুন্নাহার। ৩৪ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে ফ্রি–কিক নেন নেপালের দীপা শাহি। কিন্তু শটটি দারুণ দক্ষতায় ফিস্ট করেন রুপনা। গোল শোধে মরিয়া নেপাল তখন পাল্টা আক্রমণে ব্যস্ত। কিন্তু ৪১ মিনিটে নেপালি দর্শকদের স্তব্ধ করে দেন কৃষ্ণা। সাবিনার ডিফেন্স চেরা পাস ধরে বক্সে ঢোকেন কৃষ্ণা। দুর্দান্ত হাওয়ায় ভাসানো শটে গোলকিপার আনজিলার মাথার ওপর দিয়ে বল জড়ান জালে ২-০।

পিছিয়ে পড়া নেপাল তখন মরণকামড় দিতে ব্যস্ত। দলের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার সাবিত্রা ভান্ডারি ছিলেন ডেঙ্গু জ্বরে অসুস্থ। পুরোপুরি ফিট না হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে নামিয়ে দেন নেপালের কোচ। সাবিত্রা নামার পর আক্রমণ বেড়েছে নেপালের। সাবিত্রা আর অনিতা মিলে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের বক্সেও ঢুকেছেন। ম্যাচের ৬৯ মিনিটে ডান প্রান্ত দিয়ে ঢোকেন অনিতা। শামসুন্নাহারকে ফেলে সহজেই ঢুকে যান বক্সে। এরপর কোনাকুনি শটে বাংলাদেশের জালে জড়িয়েছেন বল। মুহূর্তেই যেন আবারও জেগে ওঠে দশরথ স্টেডিয়াম। কিন্তু সেই উল্লাস আবারও থামিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল বাংলাদেশ।

নেপালের বক্সের সামান্য বাইরে থেকে সাবিনার বাড়িয়ে দেওয়া বলে আবারও বক্সে ঢোকেন কৃষ্ণা। সামনে তখন শুধুই নেপালের গোলরক্ষক আনজিলা। সহজেই প্লেসিংয়ে কৃষ্ণা করেন ৩-১।

ঢাকা থেকে আসার আগে কোচ গোলাম রব্বানী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এবার বদলে যাওয়া বাংলাদেশকেই দেখা যাবে। কথা রেখেছেন তিনি। হিমালয় জয় করেই দেশে ফিরছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ১৯৯৯ সালে এই নেপালেই প্রথমবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়েছিল বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল, ২২ বছর পর সেই নেপালেই সেরা হলেন মেয়েরা।