পোশাক কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: একে একে বাতিল হচ্ছে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ। পোশাকের বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ১০টি সেরা ব্র্যান্ড এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তাদের ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। অনেকে আবার পণ্য জাহাজীকরণ করতে টালবাহানা করছে। এতে বিপাকে পড়েছেন দেশের পোশাক রপ্তানিকারকেরা। কোনো কোনো উদ্যোক্তা পণ্য তৈরি করেও পাঠানোর সবুজ সংকেত না পাওয়ায় প্রতিদিন লোকসান দিচ্ছেন। এভাবে ক্রয়াদেশ বাতিল, স্থগিত ও বিলম্বিত হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে পোশাক রপ্তানি খাতে ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের নিট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আইএফএস টেক্সওয়্যার। এটি ইউরোপের ফ্যাশন ব্র্যান্ড এলপিপি, লিডেলসহ বেশ কিছু রিটেইল চেইন আউটলেটের জন্য পোশাক বানায়। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা সালাউদ্দিন শামিম বলেন, তিন মাস ধরে পোল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এলপিপির জন্য বানানো পোশাক তিনি জাহাজীকরণ করতে পারছেন না। এখন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান নানা টালবাহানা করে পণ্য পাঠানোর সময় পিছিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার মোট সক্ষমতার ৪০ শতাংশ কাজ হয় ওই বহুজাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য। এর জন্য তৈরি প্রায় ৬৬ লাখ ডলারের পোশাক গত তিন মাস গুদামে পড়ে আছে। আগের পোশাক অবিক্রীত থেকে যাওয়ায় এলপিপি বলছে, তারা নতুন করে পোশাক ডেলিভারি নেবে না, আবার অর্ডারও দিচ্ছে না।’ তিনি বলেন, একদিকে এলপিপি পণ্য ডেলিভারি নিচ্ছে না, অন্যদিকে পেমেন্টও দিচ্ছে না। পণ্যগুলো ফেলে রাখার কারণে প্রতি মাসে ১২ লাখ টাকা গুদাম ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
উদ্যোক্তা সালাউদ্দিন শামিম আরও জানান, যেখানে প্রতি মাসে তাঁর নিট পোশাক রপ্তানি ছিল ৬০-৭০ লাখ ডলার, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা আগস্টে কমে হয়েছে ১৭ লাখ ডলার। এলপিপির পাশাপাশি তাঁর কারখানায় আরেক ব্র্যান্ড লিডেলের প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ হয়। নতুন অর্ডার না আসা, পণ্য ডেলিভারি নিতে না চাওয়া, ব্যাংকঋণ, শ্রমিকদের বেতন, ইউটিলিটি বিল—এই সব নিয়ে খুবই বিপর্যস্ত অবস্থায় আছেন তিনি।
তৈরি পোশাকশিল্প খাত | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইএফএস টেক্সওয়্যারের মতো অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ নিয়মিত বাতিল ও স্থগিত হচ্ছে। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও পোশাক রপ্তানিকারকেরা বলছেন, গত দুই মাসে বাংলাদেশ থেকে পোশাকের নতুন করে অর্ডার দেওয়া ও প্রস্তুতকৃত পোশাক ডেলিভারি নেওয়া বন্ধ রেখেছে অন্তত ১০টি বিশ্বসেরা রিটেইল চেইন প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ালমার্টও আছে। ব্রিটিশ ফ্যাশন চেইন পেপ অ্যান্ড কোং, আয়ারল্যান্ডের বহুজাতিক রিটেইল ফ্যাশন চেইন প্রাইমার্ক, সুইডেনের এইচঅ্যান্ডএম, ডাচ প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডএ, পোল্যান্ডভিত্তিক এলপিপি, জার্মানির লিডেল, টার্গেট, জারা, গ্যাপ, ইগলসহ অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আছে এ তালিকায়।
তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল, প্রস্তুতকৃত পোশাক ডেলিভারি নিতে ক্রেতাদের অনাগ্রহ ও ক্রয়াদেশ কমতে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত সামনের মাসগুলোতে কঠিন অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। তাঁরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব ইতিমধ্যে পড়ছে পোশাকশিল্পে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) হিসাবে, ইউরোপের অর্থনীতিতে মৃদু মন্দা চলার কারণে দুই মাস ধরে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ সময়ে আগের ক্রয়াদেশের কারণে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় থাকলেও বর্তমান সময়ে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে আগামী কয়েক মাস পরে।
অর্থনীতিবিদ ও পোশাক রপ্তানিকারকেরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপে মুদ্রাস্ফীতি ও ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষ এখন কাপড় কেনার পরিবর্তে খাদ্যপণ্য ক্রয়, বাড়ি ও গাড়ির ঋণ পরিশোধের মতো মৌলিক খাতে টাকা খরচ করছে। পোশাক বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক ক্রেতার কাছে কয়েক মাস আগের পণ্য জমে গেছে।
নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্ডার নিয়ে বুকড ছিলাম। এখন ক্রেতারা আগের অর্ডারের পোশাক বিক্রি করতে না পারার কারণে আমার ডিসেম্বরের অর্ডারের জাহাজীকরণ পিছিয়ে আগামী বছরের জুনে নিয়ে গেছে। পণ্য ডেলিভারি না নেওয়ায় আমি এলসির টাকা পরিশোধ করতে পারছি না। ফলে ব্যাংকে খেলাপি হয়ে পড়ছি। এখনো শ্রমিকদের বেতনও দিতে পারিনি।’ তাঁর প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট, প্রাইমার্ক, সিঅ্যান্ডএসহ অনেক পশ্চিমা রিটেইল চেইনে পোশাক রপ্তানি করে থাকে।
তৈরি পোশাকের অর্ডার কমা ও ডেলিভারি নিতে না চাওয়ার কথা নিশ্চিত করে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আগের অর্ডার থাকার কারণে গত দুই মাসে আমাদের পোশাক রপ্তানি ভালোই ছিল। তবে দুই মাসে ধরে আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে কম অর্ডার পাচ্ছি। বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমার হার প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ। নতুন ক্রয়াদেশ নিয়ে যাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছিল, তারা এখন আর এগোতে চাইছে না। ক্রয়াদেশ কমার সঙ্গে যোগ হয়েছে পণ্য জাহাজীকরণ না করে বিলম্বিত করার বিষয়টিও।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কোভিড-পরবর্তী বিপর্যস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতি ও ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপের অর্থনীতিতে এখন মৃদু মন্দা চলছে। এই অবস্থায় তারা পোশাকের পরিবর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ইউরোপে পোশাক রপ্তানি কমবে–এটা আগেই জানা ছিল। ইউরোপের এই মন্দা অর্থনীতি আগামী ছয় মাস পর্যস্ত থাকবে। আমাদের রপ্তানিকারকদের এখন বৈশ্বিক সমস্যার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
বিজিএমইএর সূত্র জানায়, রপ্তানির ঝুঁকি কমাতে সামনে নতুন বাজার সৃষ্টির দিকে মনোযোগ বাড়াচ্ছেন উদ্যোক্তারা। তাঁরা এখন এশিয়ার বড় অর্থনৈতিক শক্তি জাপান, কোরিয়া ও ভারতে বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা করছেন। জাপানে পোশাক রপ্তানি এক শ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। বর্তমানে জাপানের ৫ শতাংশ পোশাকের বাজার বাংলাদেশের দখলে। তাঁরা এটাকে এ বছরই ৬ শতাংশে নিয়ে যেতে চান। দক্ষিণ কোরিয়াতে রপ্তানি শিগগিরই এক শ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে। এই অর্থবছরে তাঁরা ভারতেও পোশাক রপ্তানি বাড়াতে কাজ করছেন
তবে পোশাক রপ্তানির ধারা নেতিবাচক হলে তার ধাক্কা লাগবে রিজার্ভে। এটাই ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্টদের।