১০১ বছরে মাত্র ১৮৭ বই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯২১ সালে। সেই হিসাবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স ১০১ বছর। প্রকাশনা সংস্থা সূত্র জানায়, গত ১০১ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ১৮৭টি বই। এর মধ্যে ৬৭টি বাংলা ও ১২০টি ইংরেজি। পুনঃমুদ্রিত হয়েছে মাত্র ১৭টি বই।

প্রকাশনা সংস্থা সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থায় বাড়ছে না নতুন বইয়ের সংখ্যা। মানসম্মত পাণ্ডুলিপি না পাওয়া, প্রকাশনার জটিল প্রক্রিয়া, বই প্রকাশের জন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট না থাকা এবং দুর্বল বিপণন ব্যবস্থার কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা।

শিক্ষকেরা বাইরের প্রকাশনী থেকে বই ছাপিয়ে বেশি সম্মানী পান। তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে বই প্রকাশে বেশি আগ্রহ দেখান না। বই প্রকাশের সংখ্যা কমে যাওয়ার এটিও অন্যতম কারণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের উৎসাহিত করতে তাদের রচিত গ্রন্থ প্রকাশ করা, প্রকাশিত গ্রন্থের বিপণনের ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষক নন এমন গবেষকদের গ্রন্থও সম্ভব হলে প্রকাশ করা- এসব উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থার কাজ শুরু হয়। তবে এসব উদ্দেশ্যের কোনোটাই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বছরে গড়ে দুই-তিনটির বেশি বই প্রকাশ করা যাচ্ছে না। প্রকাশনা সংস্থাটি থেকে গত এক যুগে মাত্র ২২টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশনা সংস্থার বেহাল দশা ও প্রকাশনা কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের আশা ছিল শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। আর সেটা করতে হলে প্রচুর বইয়ের দরকার পড়বে, যা প্রকাশ করবে প্রকাশনা সংস্থা। আমাদের লেখা বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরবে। কিন্তু গবেষণা, প্রকাশনা ও অনুবাদের উৎসাহটা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশনা বাড়াতে যেই উৎসাহটা দরকার সেটাও আমরা তৈরি করতে পারছি না। এই জায়গাটাতে মনোযোগ দেয়া দরকার। পাশাপাশি অনুবাদও বাড়ানো দরকার।’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, ‘শিক্ষকরা সব সময় চান তার লেখা বইটা সবাই পড়ুক। কিন্তু আমাদের বইয়ের বিপণন ব্যবস্থা ভালো না। বই বিক্রি হয় না বলে শিক্ষকদের সম্মানীও ঠিকমতো দেয়া যায় না।’

বই প্রকাশের ধাপ
কয়েক ধাপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে বই প্রকাশ করা হয়। বই প্রকাশের জন্য উপাচার্যকে প্রধান করে ১৫ সদস্যের একটি প্রকাশনা কমিটি থাকে। প্রাথমিকভাবে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে তা কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়। ওই কমিটিতে লেখা নির্বাচিত হওয়ার পর তা দুজন পর্যবেক্ষকের কাছে পাঠানো হয়। দুই পর্যবেক্ষক ইতিবাচক মত দিলে পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে ছাপার জন্য বিবেচিত হয়। কিন্তু দুই পর্যবেক্ষকের কোনো একজন আপত্তি জানালে লেখাটি তৃতীয় পর্যবেক্ষকের কাছে পাঠানো হয়। এরপর তৃতীয় পর্যবেক্ষকের মতের ভিত্তিতে পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। এরপর প্রকাশনা কমিটির আরেকটি সভায় বইয়ের সংখ্যা ও দাম নির্ধারণ করা হয়। দাম ও সংখ্যার ওপর ১৫ শতাংশ রয়্যালটি পান লেখক। কিন্তু বইটির স্বত্বাধিকার থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থার।

বই কমে যাওয়ার কারণ
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রকাশনা সংস্থার মোট বাজেট ১ কোটি ১৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর অন্যতম খাতগুলো হলো- অফিসারদের বেতন, কর্মচারীদের বেতন, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি। এই বাজেটে প্রকাশনার জন্য আলাদা নির্দিষ্ট কোনো খাত নেই। এই খাতে চাহিদা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ পরে বাজেট বরাদ্দ করে থাকে।      

বই প্রকাশের প্রক্রিয়াও জটিল। কোনো একটি লেখা যাচাই-বাছাই করে প্রকাশের অনুমতি না পেলে সেটা একজন শিক্ষকের জন্য অসম্মানজনক। তাই বেশির ভাগ শিক্ষক এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বই প্রকাশের ঝুঁকি নিতে চান না। তা ছাড়া একই বই বাইরের যেকোনো প্রকাশনী থেকে বের করলে কম সময়ের মধ্যে তা বের করতে পারেন এবং সম্মানীও বেশি পান।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থার বইরের বিপণন ব্যবস্থাও আধুনিক নয়। নতুন কোনো বই বের হলে কোনো প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় না। নেই কোনো প্রকাশনা ‍উৎসব। ফলে বইটি সম্পর্কে পাঠক তেমন জানতে পারেন না। এসব কারণে প্রকাশনা সংস্থার বই প্রকাশের সংখ্যা যেমন কমছে, তেমনি কমছে মান। পাণ্ডুলিপি নির্বাচন, অনুবাদ, সম্পাদনা, মুদ্রণ ও বিপণন শাখা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় হওয়ায় কাজের সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকাশনা সংস্থার নিজস্ব মুদ্রণালয় থাকলেও তার আধুনিকায়ন ঘটেনি। এতে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকা ও ক্যালেন্ডার ছাপানোর কাজই বেশি হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্টদের মত, আধুনিক ছাপাখানা না থাকায় বাড়তি টাকা ব্যয় করে বই ছাপার কাজ বাইরের মুদ্রণালয় থেকে করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশনার বাজেট
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট থেকে জানা গেছে, এ বছর প্রকাশনা সংস্থায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা গত বছরে ছিল ৬৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই অর্থবছরে বরাদ্দ বেড়েছে ৫৮ লাখ টাকা। মুদ্রণালয়ের বেতন ও ভাতা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা। গত বছরে যা ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা।

এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ, বিভাগ, ইনস্টিটিউটের প্রবন্ধ, জার্নাল, ম্যাগাজিন প্রকাশনায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছর বছর প্রকাশনার নানা কাজে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও সেই তুলনায় ফলপ্রসূ প্রকাশনা বাড়ছে না। বেশির ভাগ অর্থই খরচ হচ্ছে বেতন-ভাতায়।

আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা বাড়াতে প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ কয়েকজন শিক্ষক। শিক্ষকদের লেখায় উৎসাহ বাড়াতেও তারা উদ্যোগ নেন। নতুন বই প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেখা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে অনুবাদ বাড়াতেও কাজ করেন তিনি।

জানতে চাইলে প্রকাশনা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক  বলেন, ‘শিক্ষকদের কাছ থেকে খুবই কম পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। লেখার পাণ্ডুলিপি পাওয়া না গেলে তো সংস্থার কিছুই করার থাকে না। সংস্থার নিয়ম-কানুন প্রাণবন্ত না। নিয়মের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। একটা বই প্রকাশ করা খুবই সময়সাপেক্ষ। চাইলেও বিপণন বাড়ানো সম্ভব হয় না। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি বিরক্ত।’

তবে প্রকাশনা সংস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘প্রতিবছর কিছু কিছু বই আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা একটা সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান। বইয়ের মান নিশ্চিত করেই এখানে বই প্রকাশ করা হয়। সেটা সময়সাপেক্ষ হলেও গুণগতমান আমাদের রাখতেই হবে। এরপরও কীভাবে কম সময়ে বই প্রকাশ করা যায়, এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছেন সংস্থার পরিচালক।’