নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হয় গুলি ও মর্টার শেল। শনিবার দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি কক্সবাজার: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে শনিবার মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর পাঁচটি ফাইটার জেটকে আকাশে চক্কর দিতে দেখা গেছে। মাঝেমধ্যে ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টারগুলো বাংলাদেশের আকাশসীমা অতিক্রম করে গুলিবর্ষণ করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজার সীমান্তের বিপরীতে মাত্র দেড়-দুই কিলোমিটার দূরত্বে মিয়ানমারের পাহাড়ি ‘খা মং সেক’ অঞ্চল। ২৩ দিন ধরে ওই এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির তুমুল লড়াই চলছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সীমান্তের ৪০ নম্বর পিলারের কাছে বনাঞ্চলে সকাল সোয়া ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত টানা তিন ঘণ্টা হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, মর্টার শেল ও বোমা নিক্ষেপ করেছে।
জাহাঙ্গীর আজিজ আরও বলেন, বাংলাদেশের যে অংশে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া মর্টার ও গুলি এসে পড়ছে, সেখানে লোকবসতি তেমন নেই। তবে বাংলাদেশিদের ২০টির বেশি রাবার বাগান আছে। রাবার–শ্রমিকেরা আতঙ্কে বাগান ছেড়ে তুমব্রু বাজারের দিকে চলে এসেছেন। সীমান্ত এলাকায় কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় এপারে ঘুমধুমের বাসিন্দাদের পাশাপাশি শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে থাকা চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আতঙ্কে দিনযাপন করছেন।
৪০ নম্বর সীমান্ত পিলারের একটি রাবার বাগান থেকে আসা শ্রমিক গোলাম মাওলা (৪৫) বলেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাঁদের বাগানে দুটি মর্টার শেল এসে পড়ে। এ সময় আকাশে দুটি হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দিতে নিচে গুলিবর্ষণ করছিল। মাটি থেকেও ওপরের দিকে গুলি ছোড়া হচ্ছিল। দূরের আকাশে চার-পাঁচটি যুদ্ধবিমান চক্কর দিয়ে হেলিকপ্টারকে পাহারা দিচ্ছিল। দুপুর ১২টা পর্যন্ত হেলিকপ্টার দুটি থেকে শত শত গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। বিকট শব্দে ওই এলাকায় অবস্থান না করে তুমব্রু বাজারের দিকে পালিয়ে এসেছেন শ্রমিকেরা।
মিয়ানমারের যে এলাকাটিতে সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির লড়াই চলছে, সেটির নাম ‘খা মং সেক’ পাহাড়। ওই পাহাড়ের দেড় কিলোমিটার দূরে (উত্তরে) বাংলাদেশের তুমব্রু বাজার। এই বাজার থেকে মিয়ানমারে হেলিকপ্টার, জেট ফাইটারের ওড়াউড়ি, গুলিবর্ষণের দৃশ্য দেখা যায়। তুমব্রু বাজারের কোনারপাড়া এবং মিয়ানমারের ‘খা মং সেক’ পাহাড়ের মাঝখানের জায়গাটুকু নো ম্যান্স ল্যান্ড। এখানে (শূন্যরেখা) আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে পাঁচ বছর ধরে বাস করছেন রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত ৬২১টি পরিবারের ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। স্থলযুদ্ধের পাশাপাশি আকাশ থেকে ছোড়া গুলি, মর্টার শেল ও বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় আতঙ্কিত তাঁরা।
পুলিশ ও সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র জানায়, গত ২৮ আগস্ট দুপুরে মিয়ানমারের দিক থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল বাংলাদেশ অংশে এসে পড়েছিল। তবে সেগুলো অবিস্ফোরিত হওয়ায় এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা শেলগুলো নিষ্ক্রিয় করেন। এ ঘটনায় সেদিন বিকেলে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঢাকা। কিন্তু তৃতীয় দফায় আজও বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়ছে মিয়ানমারের ছোড়া একাধিক মর্টার শেল ও গুলি।
মিয়ানমারের ‘খা মং সেক’ পাহাড়ের পাদদেশে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। এই আশ্রয়শিবিরে ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ টানা ১০ বছর মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্য ছিলেন। তাঁর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মেদি পাড়ায়। দিল মোহাম্মদ (৫০) বলেন, আজ সকালে তিনটি নতুন হেলিকপ্টার থেকে শত শত গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত হেলিকপ্টার থেকে আরাকান আর্মির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অন্যদিকে স্থলভাগ থেকে হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। স্থলযুদ্ধে আর্টিলারি, মর্টার শেল, ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। আগুনে পাহাড়ের গাছপালা জ্বলছে। এতে আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত। ২২ দিন ধরে তাদের চোখে ঘুম নেই। শূন্যরেখার এই আশ্রয়শিবির ছেড়ে পালানোর জায়গাও কোথাও নেই।
ঘুমধুম পুলিশ তদন্ত ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক সোহাগ রানা বলেন, মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরেই তুমুল লড়াই চলছে। গোলাগুলি হচ্ছে, হেলিকপ্টার ও জেট ফাইটার আকাশে চক্কর দিচ্ছে। গুলির শব্দ এপার থেকে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কারা গোলাগুলি করছে, তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। আজ সকালে বাংলাদেশ সীমান্তের ৪০ নম্বর পিলারের কাছে দুটি মর্টার শেল এসে পড়েছে। এর আগে গত ২৮ আগস্ট তুমব্রু বাজারের কাছে দুটো মর্টার শেল এসে পড়েছিল।
আবু বক্কর নামে তুমব্রু বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজার ফাঁকা হয়ে পড়েছে। স্কুল-মাদ্রাসা–মক্তবে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমে আসছে। লোকজন আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।