ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ | ছবি: সংগৃহীত

আরিফুর রহমান: প্রায় ছয় বছর বন্ধ রয়েছে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। প্রতিষ্ঠানটি আবার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে চায়। এ জন্য তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা দেনা মওকুফের আবেদন জানিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির কাছে এই পাওনা মূলত বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক)। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ার কারণ ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ প্রথম বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে ২০০৭ সালে। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে মোট ৩৬টি রুটে কোম্পানিটির ফ্লাইট কার্যক্রম চালু ছিল।

একপর্যায়ে ক্ষতির মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। ধীরে ধীরে ফ্লাইট কার্যক্রম সীমিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া হয়ে ২০১৬ সালে কোম্পানিটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

ইউনাইটেড এয়ার কেন বন্ধ হলো, কোম্পানিটি দেউলিয়া হওয়ার পেছনে কারা দায়ী ইত্যাদি বিষয় জানতে চেয়ে গত সপ্তাহে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ইউনাইটেড এয়ার এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে এ চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, বকেয়ার পুরো টাকা ইউনাইটেড এয়ারকে পরিশোধ করতে হবে।

দেনা যে মওকুফ করা হবে না, এর ইঙ্গিত রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে। বেবিচকও দেনা মওকুফের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

ইউনাইটেড এয়ারের মূল মালিক তাসারুল আহমেদ চৌধুরী। তিনি লন্ডনে পলাতক। অভিযোগ রয়েছে, তাঁর দুর্নীতির কারণেই প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়েছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারের বিনিয়োগকারী ছিলেন ১ লাখ ৬০ হাজার, যাঁদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় চলতি বছরের জুনে। এর অংশ হিসেবে আট সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গত ২৯ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে বেবিচকের পাওনা ৪০০ কোটি টাকা মওকুফের আবেদন জানানো হয়। এর মধ্যে সারচার্জ বাবদ ৩০০ কোটি ও মূল বকেয়া পাওনা ৫৬ কোটি টাকা। বাকি ৪৪ কোটি টাকা পাওনা আয়কর ও ভ্যাট বাবদ।

ইউনাইটেড এয়ার নতুন করে কেন বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়, এমন প্রশ্নের জবাবে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের স্বতন্ত্র পরিচালক কাজী ওয়াহিদ উল আলম বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থে আমরা আবার এয়ারওয়েজটি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি। কোম্পানিটি আমরা আবার দাঁড় করাতে চাই। ১ লাখ ৬০ হাজার বিনিয়োগকারীর কথা চিন্তা করেই আমরা সামনে এগোনোর চেষ্টা করছি।’

দেনা পরিশোধের বিষয়ে কাজী ওয়াহিদ বলেন, দায়দেনা বাকি রেখে ব্যবসা শুরু করা যাবে না। এতে নতুন বিনিয়োগকারী আসবেন না। তাই দেনা পরিশোধের আবেদন করা হয়েছে।

তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো, যে কোম্পানি ৪০০ কোটি টাকা দেনা পরিশোধের সক্ষমতা রাখে না, তারা নতুন করে ব্যবসা করবে কীভাবে! কোম্পানি পুনরুজ্জীবিত হোক—এমনটি বিনিয়োগকারীরা চান কি না, তা মন্ত্রণালয় জানে না। এ ছাড়া কোম্পানির বর্তমান ভাঙাচোরা উড়োজাহাজ দিয়ে কীভাবে ব্যবসায় টিকে থাকবে, তা নিয়েও মন্ত্রণালয় প্রশ্ন তুলেছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে পাঠানো চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে। যাঁরা ইউনাইটেড এয়ারের টাকা তছরুপ করেছেন, তাঁদের কী শাস্তি হয়েছে, তা চিঠিতে জানাতে বলা হয়েছে।

কোম্পানিটি কেন দেউলিয়া হলো, এর জন্য কারা দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান দায় ও সম্পদের পরিমাণ কত, কোম্পানির দেনা মওকুফ করলে কীভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুবিধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে, তা জানতে চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

ইউনাইটেড এয়ার পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে যে আটজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের আইনগত ভিত্তি ও যৌক্তিকতা অর্থ মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছে।

একই সঙ্গে ইউনাইটেড এয়ার আবার চালুর বিষয়ে বেবিচক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতামত কী, সেটিও জানতে চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে হলে ইউনাইটেড এয়ারকে আগের দেনা পরিশোধ করতে হবে। কোম্পানি চালু হলে বিনিয়োগকারীরা তাঁদের পাওনা পাবেন কি না, এর নিশ্চয়তা দিতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এসব চাওয়া সম্পর্কে জানাতে অনেক সময় লাগবে। কারণ, এসব তথ্যের ব্যাখ্যা দেওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ ও জটিল বিষয়। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয় এই টাকা মওকুফে নারাজ।

এ বিষয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের এক সদস্যের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি তাঁরা পেয়েছেন। চিঠি থেকে তাঁরা এটা বুঝতে পেরেছেন যে দেনা মওকুফ করা হবে না।

পর্ষদের এই সদস্য প্রশ্ন করেন, যদি এ কোম্পানি পুনরুজ্জীবিত না হয়, তাহলে বেবিচক তাদের ৪০০ কোটি টাকা দেনা পাবে কীভাবে? এটি চালু না হলে কারও লাভ হবে না।

তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি’ আইনের আওতায় কোম্পানির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে পাওনা তোলা হবে।

ইউনাইটেড এয়ারের একটি সূত্র জানিয়েছে, বন্ধ হওয়ার পর কোম্পানির দেনা ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেবিচকের পাওনা ৪০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা। বাকি দেনা অন্যান্য খাতে।

ইউনাইটেড এয়ারের মোট ১০টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে আটটি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় রয়েছে। বাকি দুটির একটি ভারতে, অন্যটি পাকিস্তানে। এসব উড়োজাহাজ নিলামে ওঠার কথা থাকলেও তা এখন বন্ধ রয়েছে। পুরোনো এসব উড়োজাহাজের কারণে বিমানবন্দর এলাকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছে বেবিচক।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা সরেজমিন দেখেছেন, বিমানবন্দর এলাকায় থাকা ইউনাইটেড এয়ারের আটটি উড়োজাহাজ ব্যবহারের উপযোগী নয়। এগুলো বিক্রি ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। তাই এ কোম্পানি চালু হওয়ার পর আবার যাতে শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে।

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, যদি দেনা মওকুফ করা না হয়, তাহলে কোম্পানি পুনরুজ্জীবিত করার সম্ভাবনা ক্ষীণ।