১৯৩১ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করা হয় | ফাইল ছবি

প্রতিনিধি চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর নকশা তৃতীয় দফায় পরিবর্তন করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণে কালুরঘাট সেতুটি আর পদ্মা সেতুর আদলে হচ্ছে না। নকশা পরিবর্তনের কারণে সেতুটির নির্মাণ ব্যয় আরও অন্তত ৭০০ কোটি টাকা বাড়বে।


দ্বিতীয় নকশা অনুযায়ী, কালুরঘাট সেতুর ওপরতলা দিয়ে গাড়ি চলার কথা ছিল। নিচতলা দিয়ে চলার কথা ছিল ট্রেন। কিন্তু এখন পরিবর্তিত নকশা অনুযায়ী, সড়ক ও রেলের জন্য চার লেনের সেতু হবে। দুই লেনে চলবে গাড়ি। বাকি দুই লেনে ট্রেন।

প্রথম নকশায় সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় নকশায় ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। তৃতীয় নকশায় খরচ হতে পারে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিবর্তিত নকশায় সেতুটির নির্মাণ ব্যয় বাড়বে অন্তত ৭০০ কোটি টাকা। প্রথম নকশার তুলনায় এখনকার ব্যয় ছয় গুণ বেশি।

পদ্মা সেতুর আদলে করা নকশার বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। চার লেনে করা নতুন নকশার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির কাজ শুরু হবে। তারপর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। এগুলো শেষ করতে ২০২৩ সালের পুরো সময় লাগতে পারে। ২০২৪ সালে সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হতে তিন বছর সময় লাগবে।

কালুরঘাট সেতুর ফোকাল পারসন ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, নতুন নকশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গত বুধবার বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে নতুন নকশা উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকে সেতুর নির্মাণ ব্যয়, মেয়াদসহ সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী নতুন নকশায় সেতু তৈরিতে সম্মত হয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।

গোলাম মোস্তফা বলেন, নতুন নকশায় সেতু নির্মাণে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।

নতুন করে ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে গোলাম মোস্তফা বলেন, সেতুর স্থান, দৈর্ঘ্য, উচ্চতাসহ সবকিছুই আগের মতো থাকবে। তবে চার লেন হওয়ায় সেতুর প্রস্থ বেড়ে গেছে। সেতুটি এখন প্রায় ৬৫ ফুট প্রস্থের হবে। এ কারণে ব্যয় বাড়বে।

নতুন নকশার প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হতে অন্তত তিন বছর লাগবে।

আগে গত ৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের সিআরবিতে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের কার্যালয়ে কালুরঘাট সেতুর নকশা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। বৈঠকে সম্ভাব্য দাতা সংস্থা দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত এক্সিম ব্যাংকের নিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান ইওসিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন প্রাথমিক সমীক্ষা শেষে সেতু নির্মাণের স্থান, নকশা, ব্যয় ও নির্মাণকাল নিয়ে প্রাথমিক প্রস্তাব তুলে ধরেছিল।

বৈঠক শেষে রেলওয়ের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বিদ্যমান কালুরঘাট সেতু থেকে ৭০ মিটার উজানে, অর্থাৎ উত্তরে নতুন সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রস্তাবিত নকশায় সেতুর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৭৮০ মিটার। নদীর বাইরে স্থলপথ থাকবে ৫ দশমিক ৬২ কিলোমিটার। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য হবে ১০০ মিটার। মোট পিলার থাকবে আটটি। সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। সেতুর ওপরের ডেকে থাকবে সড়ক। নিচের ডেকে রেললাইন। উভয় পথ হবে দ্বিমুখী, অর্থাৎ দুই লেনের। সেতুর জন্য প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) সহজ শর্তে পুরো টাকা বাংলাদেশ সরকারকে ঋণ হিসেবে দিতে সম্মত হয়েছে।

২০১৮ সালে করা প্রথম দফার নকশা অনুযায়ী, প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১৫১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। তখন নেভিগেশন হাইট ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬ মিটার। প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার পর সেতুর উচ্চতা নিয়ে আপত্তি তোলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সংস্থাটি ১২ দশমিক ২ মিটার উঁচুতে সেতু নির্মাণের অনুরোধ জানায়। পরে নকশা দ্বিতীয় দফায় পরিবর্তন করা হয়।

প্রথম নকশার তুলনায় দ্বিতীয় নকশায় ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে গত ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত সিআরবির বৈঠকে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, আগের নকশার সঙ্গে এ নকশা মেলালে হবে না। প্রথম নকশায় এক ডেকে রেল ও সড়কসেতু ছিল। দ্বিতীয় নকশা অনুযায়ী, নতুন সেতু হবে পদ্মা সেতুর আদলে, দ্বিতল সেতু। নকশায় যেহেতু ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বাড়বে। দ্বিতীয় নকশায় ব্যয় বাড়িয়ে ছয় হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।

১৯৩১ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করা হয়। ৬৩৮ মিটার দীর্ঘ সেতুটি ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। সেতুটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলে ১০ কিলোমিটার গতিতে। সেতুটির ওপর দিয়ে ট্রেনের পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও পটিয়াগামী গাড়ি চলে। ট্রেন চলাচল করলে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। একমুখী যান চলাচলের কারণে সব সময় যানজট লেগে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে কালুরঘাটে নতুন সেতুর দাবি জানিয়ে আসছেন।