জোয়ারের তাণ্ডবে বিলীন হয়ে যাওয়া সৈকত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে চেয়ার-ছাতার ‘কিটকট’। রোববার বিকেলে কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্ট | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি কক্সবাজার: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজারে সাগর আবার বিক্ষু‌ব্ধ হয়ে উঠেছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আঘাত হানছে। রোববার সকালের জোয়ারে নতুন করে সুগন্ধা, সিগাল ও কলাতলী পয়েন্টের ৪টি অংশে ৭০-৮০ মিটার সৈকত বিলীন হয়েছে।

বেলা আড়াইটার দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ আবার জিও টিউবে বালু ভরে বাঁধ দিতে শুরু করে। ড্রেজার মেশিনে সমুদ্র থেকে পাইপে বালু টেনে ভরা হচ্ছিল জিও টিউব। এ সময় জোয়ারের পানির ধাক্কায় আগে নির্মিত জিও টিউব বাঁধের কিছু অংশ ছিঁড়ে যাচ্ছিল। একদিকে চলছে জিও টিউব বাঁধ দেওয়ার কাজ, অন্যদিকে ভাঙছে বাঁধ। ভাঙা-গড়ার এই কাজে পাউবোর বরাদ্দ ৩০ লাখ টাকা।

এর আগের কয়েক দিনের পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে সিগাল, লাবণী ও শৈবাল পয়েন্টের চার কিলোমিটার সৈকত ভেঙে গিয়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছে, এখন জোয়ারের সময় সৈকত ডুবে গেলে পর্যটকদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। ভাটার সময় পানি নেমে গেলে ভেসে ওঠে ভাঙাচোরা সৈকত। আগে পূর্ণ জোয়ারের সময় সৈকতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখা যেত। সৈকতে সারিবদ্ধভাবে বসানো হতো প্রায় দেড় হাজার চেয়ার-ছাতার ‘কিটকট’। এখন জোয়ারের সময় কিটকট বসানোর জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।

সমুদ্রের স্রোতোধারাকে স্বাভাবিক নিয়মে চলতে না দিলে তাণ্ডব চালাবেই বলে উল্লেখ করেন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা। তিনি বলেন, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সৈকত থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ হলেও পাউবো ড্রেজার মেশিনে বালু তুলে জিও টিউব বাঁধ দিচ্ছে। চোখের সামনে জোয়ারের ধাক্কায় সেই বাঁধের টিউব ছিঁড়ে যাচ্ছে।

রোববার সকাল থেকে কক্সবাজারে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল সাড়ে ১০টায় সৈকতে নেমে দেখা গেছে, জোয়ারের তাণ্ডবে বিলীন হচ্ছে সৈকতের সমিতিপাড়া, ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও শৈবাল পয়েন্টের ঝাউগাছ। এর আগেও জোয়ারে বিলীন হয়েছিল কয়েক শ গাছ।

লাবণী পয়েন্টের ওয়াচ টাওয়ার, সৈকত ঝিনুক মার্কেট, বিজিবির রেস্টুরেন্ট ঊর্মি, সেনাবাহিনীর বাংলো জলতরঙ্গের সীমানাদেয়াল ও এর দক্ষিণে ঝাউবাগান প্লাবিত হচ্ছে। ঝুঁকিতে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনা।

গত শুক্রবারের জোয়ারের তাণ্ডবে লাবণী পয়েন্টে স্থাপিত ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি তথ্যকেন্দ্র ভেঙে গিয়েছিল। সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে স্থাপিত ট্যুরিস্ট পুলিশের আরেকটি তথ্যকেন্দ্র আজ সকালে জোয়ারের ধাক্কায় হেলে পড়েছে। এটিও যেকোনো মুহূর্তে বিলীন হতে পারে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত, গত ৫০-৬০ বছরে সৈকতে এমন ভাঙনের নজির নেই। পাউবো অপরিকল্পিত বালুভর্তি জিও টিউব বাঁধের কারণে পুরো সৈকতের এমন ভাঙন দেখা দিয়েছে। তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ পাউবোর কর্মকর্তারা। তাঁদের দাবি, ভাঙনরোধে এর চেয়ে উন্নত প্রযুক্তি তাঁদের হাতে নেই।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ, পূর্ণিমা এবং বায়ুচাপের তারতম্য বেশি হওয়ায় সাগর উত্তাল হয়ে পড়েছে। উপকূলে ২ থেকে ৪ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। কক্সবাজারে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় শুরু হওয়া জোয়ার রোববার বেলা সোয়া একটা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। দুপুর ১২টার দিকে সৈকতে গিয়ে দেখা গেছে, লাবণী পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ দিকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত চার কিলোমিটার সৈকতে পা রাখার অবস্থা নেই। পুরো সৈকত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। বিচরণক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ায় বাধ্য হয়ে অনেক পর্যটক পাশের ঝাউবাগানের ভেতরে ঘোরাফেরা করেছেন। কেউ কেউ সৈকতসংলগ্ন দোকানে বসে সময় কাটিয়েছেন। বেলা সোয়া একটার দিকে ভাটা শুরু হলে পানি সরে যায়। তখন সৈকতে নামতে শুরু করেন পর্যটকেরা। কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমুদ্রে নেমে গোসল করেন।

পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা লাবণী পয়েন্টের দক্ষিণাংশে ২০ মিটারের মতো জিও টিউবের বাঁধ দিয়েছেন। আগের দুই দিন এর উত্তরাংশে আরও ৮০ মিটার বাঁধ দেন। কিন্তু জোয়ারের তাণ্ডবে নবনির্মিত জিও টিউব বাঁধ টিকিয়ে রাখা কঠিন হচ্ছে।

জানতে চাইলে পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, লাবণী পয়েন্টের ভাঙনরোধে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩ দিনে ১০০ মিটার জিও টিউব বাঁধ দেওয়া হয়েছে। সোমবার থেকে উত্তর দিকে সমিতিপাড়ায় আরও ১৫০ মিটার জিও টিউব বাঁধের কাজ শুরু হবে।

রোববার নিম্নচাপের প্রভাবে জোয়ারের তাণ্ডব বেড়েছে উল্লেখ করে তানজির সাইফ আহমেদ আরও বলেন, সুগন্ধা, সিগালসহ নতুন নতুন এলাকার সৈকত ভাঙছে। ভাঙন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খরচও বাড়তে পারে।

পাউবো সূত্র জানায়, গত মার্চে সৈকতের শৈবাল পয়েন্টের ৪৫০ মিটার ও মেরিন ড্রাইভ সড়কের সাম্পান পয়েন্টে আরও ৪৫০ মিটার জিও টিউব বাঁধ নির্মাণের বিপরীতে পাউবো খরচ করে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। কয়েক মাসের মাথায় রোদের তাপে ও জোয়ারের ধাক্কায় সেই বাঁধের বিভিন্ন অংশ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।

ড্রেজার মেশিনে সৈকতের কাছ থেকে বালু তুলে জিও টিউবের বাঁধ স্থাপন কতটা বাস্তবসম্মত, প্রশ্ন করলে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী তানজির সাইফ বলেন, ড্রেজার মেশিনে সমুদ্র থেকে বালু উত্তোলনে কোনো সমস্যা নেই। পরিবেশেরও তেমন ক্ষতি হচ্ছে না। বালু উত্তোলনের পর সমুদ্রের তলদেশের যেখানে গর্ত হবে, জোয়ারের পানিতে তা ভরাট হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৈকতে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। সমুদ্রের ভাঙন ঠেকাতে অস্থায়ী ভিত্তিতে জিও টিউব বাঁধের কাজ চালানো হচ্ছে। পরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে।

জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম বলেন, রোববার সকালের জোয়ারের পানিতে গোটা সৈকত ডুবেছিল। তখন কোনো পর্যটকের সৈকতে দাঁড়ানোর অবস্থা ছিল না। বেলা একটার দিকে ভাটা শুরু হলে একসঙ্গে ৩০-৪০ হাজার পর্যটক সৈকতে নেমে পড়েন। উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে কেউ যাতে বিপদে না পড়েন, সে জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশকে ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছে।