হোসনে আরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি কক্সবাজার: কক্সবাজারের হোসনে আরা (৩৪) খামারিদের কাছে প্রিয় নাম, বিশেষ করে নারী খামারিদের কাছে। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজননসেবা দিয়ে থাকেন। খরচপাতি বাদ দিয়ে মাসে তাঁর ১৫ হাজার টাকার মতো থাকে। স্বামীর একার আয়ে চারজনের যে সংসার একসময় চলতে চাইত না, তাতে এখন অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে।
২০১৯ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার ও পার্বত্য বান্দরবান জেলায় গবাদিপশু প্রজনন সেবাদানের জন্য কোনো নারী কর্মী ছিলেন না। সবাই পুরুষ হওয়ায় নারী খামারিরা গবাদিপশুর প্রজননের ব্যাপারে কথা বলতে স্বস্তি বোধ করতেন না। হোসনে আরা কাজ শুরুর পর নারীদের সেই অস্বস্তি কেটেছে। তাঁরা নিঃসংকোচে পরামর্শ ও সেবা নিতে পেরে গরু পালনে আগ্রহী হচ্ছেন।
হোসনে আরার বাড়ি কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের পশ্চিম ধনখালী গ্রামে। তাঁর স্বামী মো. জসিম উদ্দিন একসময় ইলিশের ব্যবসা করতেন। এখন স্ত্রীকে কাজে সহযোগিতা করেন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত দেড় বছরে হোসনে আরা পিএমখালীসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ৭৬টি গাভিকে কৃত্রিম প্রজননসেবা দিয়েছেন। গাভিগুলো জন্ম দিয়েছে ৭৫টি বাছুর। একই সময়ে ৯০টি ছাগলকে কৃত্রিম প্রজননসেবা দিয়েছেন। সেখানে জন্ম হয়েছে ১৬০টি ছাগলছানার।
পিএমখালী গ্রামের খামারি আবদুস সালাম (৫৫) বলেন, ইচ্ছা থাকলে যে উপায় হয়, এর জ্বলন্ত প্রমাণ হোসনে আরা। তাঁর পরামর্শে গ্রামের অনেক নারী এখন গবাদিপশু পালনে এগিয়ে এসেছেন। এতে বেকারত্ব দূর হচ্ছে।
তবে হোসনে আরার পথ এতটা সহজ ছিল না। মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে। ঘরে অভাব। কীভাবে সংসারে সচ্ছলতা আনা যায়, সেই ভাবনা থেকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘এসিডিআই-ভোকার’ প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তিনি কাজ শুরু করেন। সংস্থাটির কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার দায়িত্বে থাকা সিনিয়র ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর সঞ্জয় চন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, কক্সবাজারে প্রায় ২ হাজার এবং বান্দরবানে ৭০০ জন সেবাকর্মী আছেন গবাদিপশু প্রজননের। এর মধ্যে হোসনে আরাসহ মাত্র চারজন নারী। এই চার নারীর মধ্যে হোসনে আরাই প্রথম প্রশিক্ষণ নিয়ে মাঠে নামেন।
হোসনে আরার কাছ থেকে সেবা নেওয়া পিএমখালী ইউনিয়নের পাহাড়িয়ামুরা গ্রামের খামারি মো. কাজল বলেন, হোসনে আরার সহযোগিতায় এক মাস আগে একটি গাভি বাছুর দিয়েছে। এখন দুটি গাভিকে প্রজননসেবা দেওয়া হলো। তাঁর খামারে গবাদিপশু আছে ১৪টি।
দিনে ৫ থেকে ৬টি গাভির প্রজননসেবা দিয়ে হোসনে আরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করেন বলে জানান। মাসে আয় হয় ১৫ হাজার টাকার বেশি। এই কাজের পাশাপাশি তিনি বাড়িতে গবাদিপশু ও হাঁস–মুরগি পালন করেন। হোসনে আরা বলেন, ‘প্রথম যখন কাজ শুরু করি, তখন নানা সমালোচনা শুনতে হতো। কাজটা ভালোভাবে দেখত না মানুষ। এসব কানে তুলিনি।’
ধামনখালী গ্রামের গৃহবধূ সাজেদা বেগম বলেন, ‘হোসনে আরা মানুষের কথা কানে না তুলে আজ সফল। তাঁকে দেখে আমরা কাজে উৎসাহ পাই।’
কক্সবাজার সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা অসীম বরণ সেন বলেন, উপজেলায় ৫২ হাজারের মতো গবাদিপশু আছে। এর মধ্যে গরু ৩২ হাজার, ছাগল ৭ হাজার ও মহিষ ৩ হাজার। হোসনে আরা ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে গবাদিপশুর প্রজননসেবা দিয়ে খামারিদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অবদান রাখছেন। তিনি নিজেই আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন।