জোয়ারের তোড়ে বিলীন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের একটি অংশ। শুক্রবার দুপুরে সৈকতের লাবনী পয়েন্টে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টির প্রভাবে কয়েক দিন ধরে সমুদ্র প্রচণ্ড উত্তাল। এর ওপর চলছে পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাব। ফলে সমুদ্রের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আঘাত হানছে। এই অবস্থা ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া জিও টিউব বাঁধের কারণে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে বঙ্গোপসাগর। এতে করে চার কিলোমিটার সৈকত এবং এর বালুচরের ঝাউগাছ ও দোকানপাট বিলীন হয়ে গেছে বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢেউয়ের ধাক্কায় লাবণী পয়েন্টে স্থাপিত ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি তথ্যকেন্দ্র, শৈবাল পয়েন্টে শতাধিক ঝাউগাছ ও কয়েকটি দোকান বিলীন হয়ে যায়। এরপর ভাঙন রোধে গতকাল বিকেলে লাবণী পয়েন্টে ৭০-৮০ মিটারের মতো জিও টিউবে বালু ভর্তি করে বাঁধ দেয় পাউবো।
আজ শুক্রবার সকালের স্রোতের ধাক্কায় সেই বালুর বাঁধ ভেঙে যায়। এর ফলে দক্ষিণ দিকের আরও দেড় কিলোমিটার বালিয়াড়ি সমুদ্রে তলিয়ে যায়। এখন জোয়ারের পানির ধাক্কায় ঝুঁকিতে আছে ট্যুরিস্ট পুলিশের ওয়াচ টাওয়ার, সৈকত ঝিনুক মার্কেট, বিজিবি রেস্টুরেন্ট ঊর্মি, সেনাবাহিনীর বাংলো জলতরঙ্গের সীমানাদেয়ালসহ কয়েক কিলোমিটারের ঝাউবাগান।
গত ৫০-৬০ বছরে বালিয়াড়িতে এমন ভাঙনের নজির নেই জানিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, পাউবোর অপরিকল্পিত জিও টিউব ও জিও ব্যাগভর্তি বালুর বাঁধের কারণে পুরো সৈকতের এমন ভাঙনদশা। এখানে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণের নামে চলছে সরকারি টাকার লুটপাট।
সৈকত এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি তোফায়েল আহমেদ (৬০) বলেন, পাউবো নদীর মতো করে বালুর বাঁধ দিয়ে বঙ্গোপসাগরকেও শাসন করতে চাইছে। এটা কোনোমতে সম্ভব নয়। সাগরের জোয়ারের পানি বাধা পেলে আশপাশে ধ্বংসলীলা (বিলীন) চালাবেই। সৈকতেও তা–ই ঘটছে।
বালুর বাঁধ দিয়ে সৈকতের ভাঙন রোধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা। তিনি বলেন, সমুদ্রের ঢেউ ও স্রোতোধারা স্বাভাবিক নিয়মে চলে, বাধার সৃষ্টি হলে চালায় তাণ্ডব।
সৈকতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গতকাল বিকেলে পাউবোর কর্মীরা সমুদ্রের বালুচর থেকে ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলন করে ১০-২০ ফুট দূরত্বে জিও টিউবের ৩০-৪০ মিটার লম্বা বাঁধটি নির্মাণ করেন, যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জোয়ারের ধাক্কায় পানিতে তলিয়ে যায়।
আজ সকাল ১০টায় লাবণী পয়েন্টে নেমে দেখা গেছে, ট্যুরিস্ট পুলিশ ভবনের সামনে থেকে দক্ষিণ দিকে সিগাল, সুগন্ধা, কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত চার কিলোমিটার এলাকায় সৈকতে তিন থেকে ছয় ফুট গভীরতার বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ওই এলাকার সৈকতে হাঁটাচলা করার অবস্থা নেই। জোয়ারের পানিতে ভেসে আসছে মাছ ধরার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, প্লাস্টিক বর্জ্যসহ ময়লা-আবর্জনা।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে ভাঙন এলাকার পরিদর্শনে আসেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের ভাঙন বিষয়ে ব্রিফিং করেন। কবির বিন আনোয়ার বলেন, জোয়ারের ধাক্কায় সৈকত বিলীন হচ্ছে। বালিয়াড়ি-ঝাউবন ও আশপাশের স্থাপনাগুলো রক্ষায় আপাতত জিও টিউবভর্তি বালুর বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। পরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
ভাঙন এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় কক্সবাজার সৈকতের লাবনী পয়েন্টে |
কবির বিন আনোয়ার বলেন, জিও টিউব ব্যাগ মাটির ওপরে থাকলে তিন বছর টেকে। এরপর ফেটে যায়। সৈকতে জোয়ারের ধাক্কায় এই বাঁধ দীর্ঘ সময় টেকানো কঠিন কিন্তু বালিয়াড়ি তো রক্ষা করতে হবে।
ব্রিফিংয়ের সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান, পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী তানভীর সাঈদ প্রমুখ।
তানভীর সাঈদ ঘটনাস্থলে বলেন, লাবণী পয়েন্টে ইতিমধ্যে ১০০ মিটারের মতো জিও টিউব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যার কিছুটা জোয়ারে ভেঙে গেছে। এখন উত্তর দিকে সমিতিপাড়া পর্যন্ত আরও ১৫০ মিটার জিও টিউব বাঁধ নির্মাণ করা হবে, যার উচ্চতা দুই থেকে আড়াই মিটার। এ কাজে খরচ হবে ৩০ লাখ টাকার মতো।
পাউবোর অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে সৈকতে ভাঙন বেড়েছে—এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তানভীর সাঈদ বলেন, কাজ করলেও দোষ, না করলেও দোষ, করার কিছু নেই।