ইতিহাসের সাক্ষী ২৭৩ বছরের পুরোনো মন্দির

ভৈরব নদের তীরে স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন একাদশ শিবমন্দির। সম্প্রতি যশোরের অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি যশোর:  পূর্ব-পশ্চিমে প্রতি সারিতে ৪টি করে ৮টি ও সদর তোরণ এবং এর দুই পাশে ২টি—মোট ১১টি মন্দির। নাম একাদশ শিবমন্দির। যশোরের অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রামে ভৈরব নদের তীরে ২৭৩ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন এই একাদশ শিবমন্দির আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

সরেজমিন দেখা যায়, মন্দিরগুলো অনুপম কারুকার্যময়। নির্মাণশৈলী অপূর্ব। মন্দিরের গায়ের শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৭৪৫ থেকে ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চাঁচড়ার রাজা ছিলেন নীলকণ্ঠ রায়। তিনি ১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে একাদশ শিবমন্দির নির্মাণ করেন।

যশোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট এলাকা। রাজঘাটের উত্তর পাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। নদের উত্তর পাশে অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রাম। গ্রামের ভৈরব নদের তীরে গাছগাছালির মধ্যে এক আঙিনায় সারি সারি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ১১টি শিবমন্দির দূর থেকে নজরে পড়ে।

অভয়নগর গ্রামের মাধব চন্দ্র বর্মণ (৮৮) বলেন, ‘মন্দিরগুলো আমাদের ঐতিহ্য। একসময় মন্দিরে নিত্যপূজা হতো। গ্রামের প্রাণকেন্দ্র ছিল মন্দির প্রাঙ্গণ। মাঝে মন্দিরগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। সংস্কার করায় বর্তমানে মন্দিরগুলো কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে।’

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থের (১৯১৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত) দ্বিতীয় খণ্ডে ‘চাঁচড়া রাজবংশ’ অধ্যায়ে অভয়নগর একাদশ শিবমন্দিরের উল্লেখ আছে। ওই বর্ণনা অনুযায়ী, ‘এই স্থানটি অভয়া নামের বিধবা রাজকন্যার সম্পত্তিভুক্ত করে দেওয়া হয় বলে এর নাম অভয়ানগর। ভাস্কর পণ্ডিত নামক দুর্দান্ত সেনানীর অধীন মারহাট্টা বা বর্গী সৈন্য বর্ধমান অঞ্চল আক্রমণ করে। একেই ‘‘বর্গীর হাঙ্গামা’’ বলে। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বাংলায় ১২ বার বর্গীর আক্রমণ হয়। বর্গীর উৎপাতে যখন বঙ্গভূমি উচ্ছন্নে যেতে বসেছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজন্যবর্গ ভয়ে যে যেখানে পারছিলেন পালাচ্ছিলেন। অনেকে দেশ ছেড়ে পূর্বাঞ্চলে আশ্রয় নিলেন। এ সময় চাঁচড়ার রাজা ছিলেন নীলকণ্ঠ রায় (১৭৪৫-১৭৬৪)। রাজা তাঁর দেওয়ান হরিরাম মিত্রকে ভৈরব নদের তীরে গড়বেষ্টিত রাজবাটি নির্মাণের আদেশ দিলেন। রাজার সে আদেশ মোতাবেক অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রাম রাজবাটি ও শিবমন্দির গড়ে ওঠে।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা সূত্র জানায়, খুলনা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পুরাকীর্তির সংস্কার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৮১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪ টাকা ব্যয়ে একাদশ শিবমন্দিরের সংস্কার, সংরক্ষণ ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়।

একাদশ শিবমন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মিলন কুমার পাল বলেন, শিবমন্দিরটি সংস্কার-সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শিবমন্দির পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। সংস্কার-সংরক্ষণকাজ ঠিকমতো করা হয়নি।

মিলন কুমার পাল জানান, প্রতিবছর শিবমন্দির প্রাঙ্গণে নামযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিন মন্দির প্রাঙ্গণে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হয়। এসব অনুষ্ঠানে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এখানে আসেন। তা ছাড়া প্রতিদিন অনেক লোক শিবমন্দির দেখতে আসেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, শিবমন্দিরটির সংস্কার-সংরক্ষণকাজ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষণবিদের তত্ত্বাবধানে ২৭৩ বছর আগের স্থাপত্যশৈলী অনুসারে করা হয়েছে।