সংবাদ সম্মেলন বক্তব্য রাখছেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান। শনিবার রাজশাহী নগরের লক্ষ্মীপুরে | ছবি: সংগৃহীত |
প্রতিনিধি রাজশাহী: রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর হাতে গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. সেলিম রেজার মার খাওয়ার অভিযোগ সত্য দাবি করলেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান।
আজ শনিবার সকাল ১০টায় রাজশাহী নগরের লক্ষ্মীপুর এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের ধারণকৃত একটি অডিও শোনান এবং দাবি করেন, অডিওর কথাগুলো অধ্যক্ষ সেলিম রেজার। অডিওতে বলতে শোনা যায়, মারার সময় ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘এই, হকিস্টিক নিয়ে আয়। শালাকে হকিস্টিক দিয়ে মেরেই ফেলব।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী নগরের নিউমার্কেটের পাশে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মার খাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন অধ্যক্ষ সেলিম রেজা। ওই সংবাদ সম্মেলনে পাশে বসে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, তাঁরা (অধ্যক্ষেরা) নিজেরাই ধাক্কাধাক্কি করেছিলেন। তিনি (সংসদ সদস্য) মিটিয়ে দিয়েছেন।
সংসদ সদস্যের ওই বক্তব্যকে মিথ্যাচার দাবি করে আসাদুজ্জামান বলেন, ওমর ফারুক চৌধুরীর হাতে মার খাওয়ার পর অধ্যক্ষ সেলিম রেজা তাঁকে মুঠোফোনে কল দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এরপর তিনি ও কয়েকজন নেতা–কর্মী অধ্যক্ষের বাসায় গিয়ে তাঁর কথা শোনেন এবং মারধরে তিনি কোথায় কোথায় আঘাত পেয়েছেন তা দেখেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, অধ্যক্ষ এর প্রতিকার চাইলে তাঁকে দেখা করতে বলেন। পরের দিন রাত নয়টার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা ছিল অধ্যক্ষ সেলিম রেজার। কিন্তু রাত সাড়ে আটটার দিকে অধ্যক্ষ তাঁকে কল করে বলেন, তিনি অসুস্থ বলে আসতে পারবেন না। অধ্যক্ষ সেদিন তাঁকে আরও বলেন, সোহেল চেয়ারম্যান (গোদাগাড়ী দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন ওরফে সোহেল) এসে তাঁকে সংসদ সদস্যের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলিয়েছেন। তিনি (সংসদ সদস্য) সরি বলেছেন।
এরপর আসাদুজ্জামান ধারণকৃত অডিওটি শোনান। এতে বলতে শোনা যায়, ‘সেদিন এমপির অফিসে যাওয়ার জন্য আবদুল আউয়াল ওরফে রাজু (মাটিকাটা আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ) অন্য অধ্যক্ষদের ডেকেছিলেন। গিয়ে আমরা বসে ছিলাম। পাঁচ-সাত মিনিট। ওটা ওমর প্লাজার পূর্বপারে। তখন রাজু এসে বলছে, এই এমপি উঠে যাবে। সব ঢোকেন, ঢোকেন, ঢোকেন। ঢুকতেই প্রথম কথায় আমাকে বলছে, “সেলিম, তোমার কলেজে কী হয়েছে?” আমি বলছি, কই স্যার? কিছু তো হয়নি। তখনই যা ভাষা... “...বাচ্চা,... বাচ্চা, তোর অফিসে বসে আমার নামে, রাজুর পরিবার নিয়ে, আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলিস, টিচাররা কথা বলে। তুই আমাকে না বলে, ওই টিচারদের বিচার না করে...” বলে এই উঠে এসেই মনে করেন যে কিল, ঘুষি, লাথি।’
অডিও রেকর্ডে আরও বলতে শোনা যায়, ‘বারবার উঠছে, বসছে, মারছে। প্রিন্সিপালকে দিয়েই পর্দা টানাইছে। রাজু পর্দা টেনে দিল। বলছে, “এই, হকিস্টিক নিয়ে আয়। শালাকে হকিস্টিক দিয়ে মেরেই ফেলব। শালা আমার বিরুদ্ধে কথা বলে।” তো আমি তো নিজেই জানি না কখন এটা রেকর্ডিং হয়েছে, কী কথা হয়েছে। অডিওতে পাশের এক ব্যক্তিকে প্রশ্ন করতে শোনা যায়, “কোন টিচার রেকর্ডটি করেছিল, ওটার কী নাম?” অধ্যক্ষ (সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা) বলেন, “সিরাজুল ইসলাম। এ আবার একজনকে চাকরি দেবে বলে তিন-চার লাখ টাকা নিয়েছিল। রাজাবাড়ির জনি। জনির কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছে। জনি গত ১৯ তারিখে একটা দরখাস্ত দেয় আমাকে আর সভাপতিকে। এই সিরাজকে তখন আমি বলি, “এই যে জনি আপনার নামে লিখিত দিয়েছে, এটা বাইরে বাইরেই আপনি মিটআপ করে ফেলেন। তা না হলে আমি গভর্নিং বডিতে তুলব।” এ ঘটনার আগেই কিন্তু ওই রেকর্ডিংগুলো করে রাজুকে দিয়ে দিয়েছে আমাকে-টিচারদের ফাঁসানোর জন্য। পাশের ব্যক্তিকে আবারও বলতে শোনা যায়, “প্রিন্সিপালদের ভূমিকা (মারার সময়)?” তখন অধ্যক্ষ (সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা) বলেন, “কোনো ভূমিকা না, আমাকে বলছে, মাফ নেন, মাফ নেন। তো আমি কিসের মাফ নেব? তারপরও বললাম, তো স্যার আমি তো জানি না, যদি আমার টিচাররা ভুল করে থাকে আর হবে না। এই “যদি” লাগিয়েছি দেখে আরও রাগ। উঠে আবার মাইর। প্রায় ১০ মিনিট।’
অডিওতে আরও বলতে শোনা যায়, ‘বিকালে প্রিন্সিপালরা এসেছিল আমার খোঁজ নিতে। তারা বলছে, “স্যার, যা হওয়ার হয়েছে আর মাইরেন না।” এটা তাঁরা নাকি যাইয়া বলেছে। আমি সকালে আবার শিবলীকে (অন্য এক কলেজের অধ্যক্ষ) জিজ্ঞেস করলাম। শিবলী বলছে, “তাঁর (সংসদ সদস্য) রাগ কমেনি। টিচারদের ওপরেও রাগ আছে। তাঁদেরকেও মারবে এ রকম।” আমি বলছি, আপনারা আপনাদের মতো থাকেন। আমাকে আমার মতো থাকতে দেন। আমাকে ডাকলেও আর যাব না। তাতে ওর ক্ষমতা থাকলে আমার চাকরি খেয়ে লিবে।’
সংবাদ সম্মেলনে শোনানো অডিও রেকর্ডিংয়ের বিষয়ে কথা বলতে অধ্যক্ষ সেলিম রেজার মুঠোফোনে একাধিক কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। অধ্যক্ষ সেলিম রেজার বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভিন অডিওটি শুনে বলেন, তাঁর স্বামীর মতো করে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু হয়নি ।এটা তাঁর স্বামীর কণ্ঠস্বর বলে মনে হচ্ছে না। বাক্য শেষের টানগুলো তিনি এভাবে দেন না।
অন্যের অডিও অনুমতি ছাড়া ফাঁস করা বেআইনি কি না, জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পদাক আসাদুজ্জামান বলেন, সত্যকে প্রকাশ করার জন্য তিনি এটা করতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ যদি মোকাবিলা করতে চায়, তিনি আদালতে যেতে প্রস্তুত আছেন। সেখানে এটাও প্রমাণিত হবে কণ্ঠস্বরটি কার।
ওই অডিও রেকর্ডিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘এত পরে কেন এই রেকর্ডিং আসছে। এত বড় অস্ত্র থাকতে কেন তা আগেই বের করা হয়নি। একজন মানুষ সরাসরি জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে বললেন যে তাঁকে মারা হয়নি। তাঁরা নিজেরাই ওটা করেছেন। এ রকম সাক্ষাৎ বক্তব্যকে কি কোনো ডকুমেন্ট দিয়ে মোকাবিলা করা যায়? আমি রেকর্ডিংটা শুনেছি। আমার মনে হয়েছে, এটা অধ্যক্ষের গলা নয়। এখন তো প্রযুক্তি ব্যবহার করে গলা নকল করা যায়। আমি বলছি না, এটা করা হয়েছে কিন্তু করা সম্ভব।’
অধ্যক্ষের বাসায় সোহেল চেয়ারম্যানকে পাঠিয়ে ভিডিও কলে ‘সরি’ বলার অভিযোগ প্রসঙ্গে ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘সোহেল তাঁর এলাকার চেয়ারম্যান, সে যেতেই পারে। তাঁকে পাঠিয়ে সরি বলতে হবে কেন। আমি টোটাল বিষয়টার জন্যই তো সরি বলছি।’
রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁর রাজশাহীর থিম ওমর প্লাজার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ৭ জুলাই রাতে অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। সেখানে আরও কয়েটি কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষরা উপস্থিত ছিলেন।