রূপকথা-বাস্তবতার ‘হাওয়া’য়

পোস্টার, ট্রেলার আর গানে মুক্তির আগেই ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল। তবে মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া প্রথম দিনই ‘ঝোড়ো হাওয়া’ তৈরি করবে, কে জানত। মুক্তির আগেই প্রথম তিন দিনের আগাম টিকিট বিক্রি শেষ হওয়া, কালোবাজারে তিন গুণ বেশি দামে টিকিট বিক্রি, টিকিট পাওয়া নিয়ে সংঘর্ষ মিলিয়ে গত কয়েক বছরে বাংলা সিনেমার অনেক চেনা দৃশ্য বদলে দিয়েছে সান মিউজিক অ্যান্ড মোশন পিকচার্স লিমিটেড প্রযোজিত সিনেমাটি। 

দীর্ঘদিন পর টিকিটের জন্য এমন লাইন দেখা গেছে পাবনার রূপকথা সিনেমা হলের সামনে | ছবি: সংগৃহীত

মুশফেকা ইসলাম: মাছ ধরা বোট নয়নতারার সরদার চান মাঝি একটা পাখি পোষে। নিজে জলপানের সময় পাখির খাঁচার খুরিতেও সে জল ঢেলে দেয়। নিয়ম করে খেতে দেয় পাখিটিকে। আবার পথ হারিয়ে এই শালিককে উড়িয়ে দেয় সে। পোষা পাখির ফিরে না আসায় আশা খোঁজে। তারপর পাখি ফিরে আসে। সেটিকে পুড়িয়ে উদরস্থ করতেও সময় লাগে না চানের। হলভর্তি দর্শক চোখমুখ কুঁচকে ‘চান’ চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর চিবিয়ে চিবিয়ে পোষা পাখির হাড়মাংস খাওয়া দেখেন। তীব্র রোমাঞ্চ আর ঘৃণা নিয়ে তাকান। দৃশ্যটি তাঁদের মাথায় গেঁথে যায় অনেক দিনের জন্য।

আবার ছবির শুরুতে আচমকা ঝপাং শব্দে জল ছিটিয়ে গভীরে ডুব দেওয়া নোঙরটা দর্শককেও গেঁথে ফেলে। তারপর চমকে গিয়ে এই ‘হুকড’ দর্শকের দল টুঁ শব্দ না করে ঠায় বসে থাকে ঘণ্টা দুয়েকের বেশি। যেন ঘোরে পাওয়া সব! ‘হাওয়া’য় পাওয়া। মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’র বাঁকে বাঁকে এমনই সব গা শিউরানি আর চমক আছে।

পুরো সপ্তাহের টিকিট অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাওয়া ‘হাওয়া’ আসলে কী নিয়ে? প্রথমেই আছে প্রান্তজনের জীবনের গল্প। তার কতকটা স্বার্থপরতা, ভয় আর দ্বন্দ্বের। কতকটা সাগরের বৈরী পরিবেশ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে টিকে থাকার যৌথ সংগ্রামের। কতকটা প্রেম আর ঈর্ষার। তাহলে হাওয়া কি শুধু গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের গল্প? না, তার চেয়ে একটু বেশি কিছু যেন। জেলেজীবনের গল্পের সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া খুব বেশি করে জলেরও গল্প। যে গল্পের শুরুটা হয়েছিল পুরাণে, তবে জলজীবীদের মুখে মুখে পুরোনো হয়নি আর।

‘হাওয়া’ সিনেমায় চান মাঝি চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী | ছবি: সংগৃহীত
চান মাঝি, ইব্রাহীম, নাগু, এজাদের মতো দাপুটে সব চরিত্রের ভিড়েও হাওয়ার ‘হিরো’ তাই জল—সাগর। ক্যামেরায় আদি-অন্তহীন সবুজে নীল জলের গোমর বারবার সে কথাই মনে করায়। মাঝদরিয়ায় সিনেমা বানানোর এ বিপুল আয়োজন কী করে সম্ভব হলো, দেখতে দেখতে মনে প্রশ্ন জাগে বারবার।
 
পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন নাটক আর বিজ্ঞাপনের ছবি বানিয়ে হাত পাকিয়েছেন অনেক দিন। তবু প্রথম সিনেমাতেই বৈরী সাগরকে মূল লোকেশন ধরে ছবি তৈরি করা বেশ হিম্মতের কাজ। দর্শক হিসেবে বলতে পারি, এ কাজে তিনি সফল হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এই প্রাক্তনী ছবিটিতে ওয়াইড শটের অনেকগুলোকেই রং, আলোছায়া আর কম্পোজিশনের যোগসাজশে কখনো পেইন্টিং বলে ভ্রম হয়। আবার গভীর রাতে বাতাসে মেলা শাড়ি আর নায়িকার এলোচুল মিলেমিশে কখনো বা দৃশ্যটি হয়ে ওঠে কবিতা। লাইটিং, ছবির কালার গ্রেডিং, আবহ সংগীত বাস্তব আর জাদুবাস্তবতার মাঝামাঝি ঘোর জাগিয়ে রাখে। তাই মগ্ন দর্শক কখন যে ‘নয়নতারা’ বোটে চড়ে বসেন চরিত্রগুলোর সঙ্গে, হলের বাতি জ্বলে ওঠার আগে সেটা আর ঠাওর হয় না তাঁদের।

ছবির প্রচারের সময়ই ছবির নির্মাতা ও কলাকুশলীরা জানিয়েছেন, গল্পটা জেলে আর জলের মিথ নিয়ে। সেই গল্পে ঢুকে যেতে নির্মাতা মোটেই সময় নেননি।

চেনা অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী (চান মাঝি), শরিফুল রাজ (ইব্রাহীম), নাসির উদ্দিন (নাগু) প্রমুখ শুরুতেই শহুরে দর্শকের অচেনা চরিত্র, সমুদ্রে মাঝ ধরা জেলে হিসেবে ধরা দেন এবং দর্শকদের ধরেও ফেলেন, আটকে দেন তাঁদের দুর্দান্ত অভিনয়ে।

‘হাওয়া’য় গল্প এগোয় খুব সাবলীলভাবে। তবে মাঝিদের গালাগাল আর হল্লার মধ্যেও গল্পের সুরটা কিন্তু মৃদু। গুলতীর (নাজিফা তুষি) আগমনে চরিত্রদের মধ্যে সন্দেহ বাড়ে। দ্বন্দ্ব বাড়ে। বাড়ে ভয়ও। সমুদ্রজীবীদের সমুদ্রকেন্দ্রিক ভয়গুলোর সঙ্গে দর্শক পরিচিত হয়। গল্প এগোয়। চান মাঝির গল্প চাঁদ সদাগরের হাত ধরে চলে। আর গুলতীর কিসসা ভাসে দরিয়ায়, অনেকগুলো মৃতদেহ সঙ্গে নিয়ে।

হাওয়ায় গুলতি নাজিফা তুষি  | ছবি: সংগৃহীত
তবে শুধু মৃত্যু নয়, এখন সিনেমা হলে বয়ে চলা হাওয়া জীবনেরও গল্প; যে জীবন বাস্তব, যে জীবন রূপকথার এবং যে জীবনে আছে রূপকথা-বাস্তবতার হাওয়া!