নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন একজন শিক্ষক। বৃহস্পতিবার রাজধানীর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
মোশতাক আহমেদ: এখন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র হয় দুই ধরনের। একটি অংশে থাকে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র, যেখানে একটি প্রশ্নকে চার ভাগে ভাগ করে উত্তর জানতে চাওয়া হয়। আরেকটি অংশে থাকে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ)।
কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ও কাঠামোগত বড় পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রশ্নপত্রের ধরনও বদলে যাবে। পরীক্ষার প্রশ্নগুলো সৃজনশীল হলেও তার কাঠামো এখনকার মতো হুবহু থাকবে না। নতুন শিক্ষাক্রমে একটি অংশের মূল্যায়ন হবে সারা বছরের ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। আরেকটি অংশের মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে। এতে প্রশ্নের ধরন নির্ভর করবে বিষয়ের প্রকৃতি, যোগ্যতা অর্জনের চাহিদা এবং অভিজ্ঞতার ধরনের ওপর। প্রশ্নগুলো হবে সমস্যা সমাধানভিত্তিক। দুই ক্ষেত্রেই প্রশ্ন প্রণয়নে শিক্ষকদের স্বাধীনতা থাকবে। অর্থাৎ উত্তর জানার প্রশ্নগুলো মিশ্র ধরনের।
দেশের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হয় গত ৩০ মে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশ্নপত্রের ধরন কেমন হবে, এখন তা নিয়ে কাজ চলছে। এ বিষয়ে এখনো খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। প্রাথমিক রূপরেখা মাথায় নিয়ে কাজটি হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে পুরো শিখন শেখানো ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি হবে সৃজনশীল।
তবে যেহেতু আগের মতো মুখস্থ ও তথ্যভিত্তিক পরীক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, কাজেই এখানে (নতুন শিক্ষাক্রম) মূল্যায়নের ধরন হবে একেবারে ভিন্ন। শিখনকালীন মূল্যায়নে যেমন শিক্ষার্থীকে তার শিখনের বিভিন্ন পর্যায়ে পারদর্শিতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে, তেমনি সামষ্টিক মূল্যায়ন (পরীক্ষা) প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন আসবে। সামষ্টিক মূল্যায়নে লিখিত পরীক্ষা পুরোপুরি উঠে না গেলেও লিখিত পরীক্ষায় প্রচলিত ব্যবস্থায় যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, সেভাবে হবে না। এ নিয়ে কাজ চলছে।
এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) বাস্তবায়ন শেষে আগামী বছর থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এতে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে কোনো পরীক্ষা থাকবে না; শতভাগ মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন ধারাবাহিকতার ওপর।
আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। বাকি ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার ভিত্তিতে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন এবং ৪০ শতাংশ হবে পরীক্ষার ভিত্তিতে।
নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৫০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন; বাকি মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে। ওই সব শ্রেণির অন্যান্য বিষয়ে পুরো মূল্যায়নই হবে শিখনকালীন। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নে বেশি জোর দেওয়া হবে। এই স্তরে ৭০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে এবং বাকি ৩০ শতাংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন।
শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত একজন শিক্ষক বলেন, পরীক্ষার ভিত্তিতে করা মূল্যায়নে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ারও সুযোগ থাকছে। এখন মূলত শিক্ষার্থীরা তার পঠিত তথ্য কতখানি মনে রাখতে পারে এবং কত নির্ভুলভাবে তা লিখে উপস্থাপন করতে পারে, তার ওপরেই নম্বর দেওয়া হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে তথ্য মনে রাখার ক্ষমতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে তার তথ্য বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা এবং তথ্য ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর।
নতুন শিক্ষাক্রমে বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং সমমানের পরীক্ষা থাকছে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।
এনসিটিবি সূত্রমতে, পাবলিক পরীক্ষায় মূল্যায়ন শুধু লিখিত হবে না। যেসব বিষয়ের জন্য লিখিত পরীক্ষা প্রয়োজন তা অবশ্যই থাকবে। তবে সৃজনশীল প্রশ্ন হিসেবে এত দিন যেভাবে হচ্ছে, তা থাকছে না। প্রতিটি বিষয়ে নিজের মতো করে সামষ্টিক মূল্যায়ন এবং পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়নের স্বাধীনতা থাকবে শিক্ষকদের।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, একজন শিক্ষার্থীর দক্ষতা অর্জন হলো কি না, সেটাই এখানে মুখ্য। ফলে প্রশ্নপত্র প্রণয়নে মিশ্র ব্যবস্থা থাকবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে আরও কিছুদিন লাগবে।
মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশ্নপত্রের ধরন বদলাতেই পারে। তবে এখনো জানতে পারিনি কীভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হবে। যতটুকু জানা গেল, তাতে কেবল প্রশ্নপত্র প্রণয়নে শিক্ষকদের ঢালাও স্বাধীনতা দিলেই হবে না, প্রশ্নপত্র হতে হবে শিক্ষাক্রমে কী প্রত্যাশা করা হচ্ছে তার ভিত্তিতে। না হয় এর যথার্থতা নষ্ট হতে পারে।
তাই আরও ভেবেচিন্তে এবং বিচার–বিশ্লেষণ করে প্রশ্নপত্রের ধরন ঠিক করে দিতে হবে। এর আলোকে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সৃজনশীল প্রশ্নপত্রও কিন্তু সব শিক্ষক রপ্ত করতে পারেননি। তাই এখন প্রশ্নপত্রের ধরন বদলাতে গিয়ে এমন কিছু করা যাবে না, যেটি আবার সৃজনশীলের প্রশ্নপত্রের মতো হয়।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে জোর
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবেন শিক্ষকেরা। আবার মূল্যায়নের বড় দায়িত্ব শিক্ষকদের হাতে। ফলে একদিকে শিক্ষকদের কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন বন্ধ না করলে এবং তাঁদের দক্ষ না করে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করলে বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তাও বলছেন, এই বাস্তবতা মাথায় রেখে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় পৌনে আট লাখ শিক্ষককে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর মধ্যে মাধ্যমিকে প্রায় চার লাখ এবং প্রাথমিকে প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষক রয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পথরেখাও ঠিক করা হয়েছে।
অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, খসড়া পথরেখা অনুযায়ী আগামী অক্টোবর মাসে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৬৪ জেলায় প্রতি বিষয়ে তিনজন করে ‘কোর প্রশিক্ষক’ বাছাই করা হবে।
এরপর নভেম্বর মাসে কোর প্রশিক্ষকেরা নিজ জেলার প্রতিটি উপজেলায় প্রতি বিষয়ে তিনজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাছাই করবেন। উপজেলার এসব প্রশিক্ষকের মাধ্যমে ডিসেম্বরে সারা দেশে ৫২০টি উপজেলা ও থানার মাধ্যমিকের সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। একই প্রক্রিয়ায় প্রাথমিকের প্রায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার শিক্ষককেও ডিসেম্বরের মধ্যে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে জানান এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) এ কে এম রিয়াজুল হাসান।