উজানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান কেটে বিলকুজাইন ঘাটে জমা করছেন কৃষকেরা। আজ গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের বিলকুজাইন এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চোখের সামনে তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্নের সোনালি ধান। টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি ও উজানে ধেয়ে আসা পুনর্ভবা নদীর পানির তোড়ে স্থানীয় মানুষের তৈরি বাঁধ ভেঙে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী গোমস্তাপুর উপজেলার বিলকুজাইন এলাকার প্রায় তিন হাজার বিঘা জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। ধান কাটার মৌসুমে এমন ঘটনায় দিশাহারা ওই এলাকার দেড় থেকে দুই হাজার কৃষক।

এ ছাড়া পুনর্ভবা নদীর ওপর নির্মিত কাঠের সেতু ডুবে যাওয়ায় প্রায় ১০ হাজার বিঘার ধান কেটে নিয়ে আসতেও চরম সংকটে পড়েছেন কৃষকেরা। এ অবস্থায় ধান কাটার শ্রমিকের সংকট ও মজুরি প্রায় তিন গুণ হয়ে যাওয়ায় মরার উপর খাঁড়ার ঘা অবস্থা হয়েছে চাষিদের।

আজ দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান কেটে নৌকায় করে বিলকুজাইন ঘাটে জমা করছেন চাষিরা। কেউবা ট্রাক্টরে ধান পরিবহন করছেন। দিশাহারা চাষিদের অনেকেই করুণ অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে চোখের জল ফেলেন। কয়েকটা দিন হাতে পেলেই সব ধান ঘরে তুলতে পারতেন তাঁরা।

ইশ্বরপুরগঞ্জের কলেজশিক্ষার্থী মো. জুয়েল বলেন, ‘বাবা গরিব বর্গাচাষি। ১১ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। সবই তলিয়ে গেছে। মাত্র দুই বিঘা জমির ধান কাটতে পেরেছি। ধান কাটার শ্রমিকের দারুণ সংকট। ৩০০ টাকার মজুরি এখন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। লেখাপড়া ছেড়ে ধান কাটতে নেমেছি। আমার মতো অনেক ছাত্রই এখন বিলে ধান কাটছেন। কী যে করুণ অবস্থা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভেবে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছি।’ একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন জুয়েল।

টানা বৃষ্টি ও উজানের পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্নের সোনালি ধান। আজ গোমস্তাপুর উপজেলার বিলকুজাইন এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

এলাইপুর গ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ওঁরাওয়ের রুমালি কেরকেটা কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। দলবেঁধে ধান কাটতে এসেছেন। ১০ দিন আগে থেকে ধান কাটছেন। তিনি বলেন, আগে ৩০০ টাকা মজুরিতে ধান কাটলেও ২ দিন থেকে ৬০০ টাকায় কাজ করছেন। ডুবে থাকা ধান কাটতে খুব কষ্ট। পুরুষেরা আরও বেশি মজুরি নিয়ে ধান কাটছেন বলে জানান তিনি।

ইশ্বরপুরগঞ্জের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম (৫২) বলেন, ‘আমি ১০ বিঘা ও ছোট ভাই ৩০ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছিল। হামারটা খানিক ডুবলেও ছোট ভাইটার ২০ বিঘার ব্যাবাকই লষ্ট। অরতো পাগল হওয়ার দশা।’ কৃষক আবদুল হাকিম বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা সব পড়ালেখা করে। ধান বিক্রি করেই তাদের খরচ চালাই। এখন পেটে খাব না ছেলেমেয়েদের খরচ চালাব, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না। ১৫ বিঘা জমির ধান সব তলিয়ে গেছে।’

দুবইল গ্রামের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য ইউসুফ আলী বলেন, বিলকুজাইন ঘাটের ওপর একটি সেতু আছে। এর নিচ দিয়ে বিলের সংযোগ খালের পানি প্রবাহিত হয়। এ সেতুর নিচে একটি স্লুইসগেট থাকলে ধান তলিয়ে যেত না। পানি আটকানোর জন্য স্বেচ্ছাশ্রমে খালে একটি অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন স্থানীয় কৃষকেরা। কিন্তু পানির তোড়ে সেটিও ভেঙে গেছে। কৃষকেরা দীর্ঘদিন ধরে স্লুইসগেট ও পুনর্ভবা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। ভোটের সময় সংসদ সদস্য প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ভোট শেষ হলে সবাই ভুলে যান।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে এসেছিলেন গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ সরকার। সঙ্গে ছিলেন তিনজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। তানভীর আহমেদ বলেন, উজান থেকে ধেয়ে আসা পুনর্ভবা নদীর পানি ও বৃষ্টির পানিতে উপজেলার আড়াই থেকে তিন হাজার বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। এসব ধানের বেশির ভাগই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধান তলিয়ে যাওয়ায় অনেক কৃষক দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

ধান কাটার মৌসুমে এমন ঘটনায় দিশাহারা ওই এলাকার দেড় থেকে দুই হাজার কৃষক। আজ উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের বিলকুজাইন এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
বহু কৃষকই তাঁদের করুণ দশার কথা বলতে ভিড় করেন। চোখের পানি মুছেন কেউ কেউ। কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে স্কুলশিক্ষক কবির উদ্দিনেরও। তিনি এলাকার চেরাডাঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনিও শ্রমিক দিয়ে ২০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। সবই এখন পানির তলে।