তাঁর হাতে ব্যাট তুলি, মাঠ ক্যানভাস

শতকের পর লিটন। মুশফিক অভিনন্দন জানান তাঁকে  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

উৎপল শুভ্র: এর আগেও নামটা কানে এসেছে। তবে লিটন দাস যে কারণে লিটন দাস, সেই কারণটা আমাকে প্রথম বলেছিলেন সাকিব আল হাসান। ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করছেন বলে স্কোরকার্ডে দেখে দেখে নামটা পরিচিতই ছিল, কিন্তু মাঠে বসে লিটনের ব্যাটিং তখনো সেভাবে দেখা হয়নি।

২০১৪ সালের কোনো এক সন্ধ্যায় সাকিবের মুখে তাঁর সেই দিনের কর্মকাণ্ডের বিবরণে প্রসঙ্গক্রমে লিটনের আবির্ভাব। কী একটা কাজে মিরপুর স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন। বেশিক্ষণ থাকতে চাননি। কিন্তু থাকতে হয়েছিল; কারণ, লিটন দাস তখন ব্যাটিং করছিলেন। প্রিমিয়ার লিগের কোনো ম্যাচেই কি? সম্ভবত তা-ই। নিশ্চিতভাবে মনে করতে পারছি না।

সাকিবের তখন ঘোর দুঃসময়। ‘অ্যাটিটিউড প্রবলেম’-এর কারণে বিসিবি তাঁকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। বনানীর ডিওএইচএসের বাসায় সেই সন্ধ্যায় সাকিবকে যে চেহারায় দেখেছিলাম, এর আগে-পরে কখনো তাঁকে এমন দেখিনি। রীতিমতো ভেঙে পড়া এক তরুণ। সহমর্মী সাংবাদিক বাসায় এসেছেন, সেই সৌজন্য থেকেই হয়তো একটু-আধটু হাসার চেষ্টা করছেন। সেই হাসিতেও ঝরে পড়ছে বিষণ্নতা। প্রায় শোকাতুর সেই সন্ধ্যায় একবারই মনে হয় সাকিবের মুখে একটু আলোর আভা দেখেছিলাম। সেটি কখন? যখন তিনি বলছেন, ‘লিটনের ব্যাটিং দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। কী যে সুন্দর ব্যাটিং করে!’

এর পর থেকে যখনই লিটনের ব্যাটিং দেখি, কেন যেন অবধারিতভাবে সাকিবের ওই কথাটা মনে পড়ে। কাল মিরপুরে লিটনের সর্বশেষ মাস্টারপিসটা দেখতে দেখতেও যেমন পড়ছিল। লিটনের ব্যাটিং দেখা অনির্বচনীয় এক অভিজ্ঞতা। শুধু ব্যাট-বলের লড়াই বা রানে যা ব্যাখ্যা করার নয়। তাহলে সেটি কেমন? টেস্ট অভিষেকের প্রায় ছয় বছর পর গত নভেম্বরে চট্টগ্রামে পাকিস্তানের বিপক্ষে লিটনের প্রথম টেস্ট শতকের পর যা লিখেছিলাম, সেটাই আবার তুলে দিলে হয়—লিটনের ব্যাটিং দেখা চোখের আরাম, মনের শান্তি। ব্যাটিং জিনিসটা তো একটা কাষ্ঠদণ্ড দিয়ে সাড়ে পাঁচ আউন্স ওজনের গোলাকৃতি বলটাকে মারা বা ঠেকানোই…কিন্তু কারও কারও হাতে সেটিই উত্তীর্ণ হয় শিল্পের কাতারে।

সেই ‘কারও কারও’ লেখার সময় চোখে ভাসছিল ডেভিড গাওয়ার, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, মার্ক ওয়াহ, ভেঙ্কট লক্ষ্মণ, মাহেলা জয়াবর্ধনে...এমন কিছু নামও। এঁদের মধ্যে মার্ক ওয়াহর সঙ্গেই বোধ হয় লিটনের বেশি সাদৃশ্য। সবকিছুই নরম, সবকিছুই পেলব, সবকিছুতেই অলস এক সৌন্দর্য...‘লাবণ্য’ শব্দটা দিয়ে বোধ হয় যা সবচেয়ে ভালো বর্ণনা করা যায়। চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে দেওয়া যে ব্যাটিং দেখতে দেখতে মনে হয়, আহা, এ যেন সহজে শেষ না হয়!

লিটনের ব্যাটিংয়ে সবকিছুই সুন্দর। তারপরও কালকের ইনিংসটি যখনই ফিরে দেখছি, সবার আগে চোখে ভাসছে ওই পুল শটগুলো। পুল কত প্রকার ও কী কী, যেন তার এক প্রদর্শনী! এই পুল শটটার মধ্যে একটা ‘মাচো’ ব্যাপার আছে। লিটন এখানেও ব্যতিক্রম। তাঁর পুল শটে আগ্রাসনের হুংকার নেই। হয়তো আছে, তবে সেটি প্রচ্ছন্ন। লাবণ্যের মোড়কে যে তা ঢাকা পড়ে থাকে।

সব সময়ই তা থাকত। টেস্ট অভিষেকে ৪৪ রানের ছোট্ট এক ইনিংসেই তো তিনি হার্শা ভোগলেকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিলেন মুগ্ধতায়। সেই মুগ্ধতা অবশ্যই ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্যে। কিন্তু শুধু সৌন্দর্য ধুয়ে কি আর জল খাওয়া যায়? ব্যাটিংয়ের শেষ কথা তো রান, সেখানেই আক্ষেপ ছিল লিটনকে নিয়ে। এমন এক প্রতিভা, অথচ প্রথম ২৫ টেস্টে কিনা একটাও সেঞ্চুরি নেই! সেই অতৃপ্তি, সেই দুঃখ, সেই আক্ষেপও এখন ঘুচিয়ে দিচ্ছেন লিটন। গত সোয়া এক বছরে ১৩ টেস্টে প্রায় এগার শ রান। গড় ৫৫ ছুঁইছুঁই। ৩টি সেঞ্চুরি ও ৭টি হাফ সেঞ্চুরি। ওই ৭ হাফ সেঞ্চুরির তিনটি আবার ৯৫, ৮৮, ৮৬ রানের। এই হিসাব কালকের অপরাজিত ১৩৫ রান যোগ করেই।

কী পরিস্থিতিতে এই ইনিংস, তা মনে রাখলে এটির মূল্য অনেক গুণ বেড়ে যায়। চট্টগ্রামে লিটনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটাও প্রবল বিরুদ্ধস্রোতের বিরুদ্ধে। তবে কালকের মিরপুরের মতো এতটা নয়। চট্টগ্রামে ৪৯ রানে পড়েছিল ৪ উইকেট আর এখানে ২৪ রানে ৫। ঘটনাচক্রে দুই টেস্টেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ে লিটনের সঙ্গী মুশফিক।

চট্টগ্রামে পঞ্চম উইকেটে দুজনের ২০৬ রান। আর মিরপুরে অসমাপ্ত ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে এরই মধ্যে ২৫৩। টেস্ট ক্রিকেটে ষষ্ঠ উইকেটে এর চেয়েও বড় জুটি আছে আরও ২০টি। যার আটটি ৩০০ রানের বেশি। সর্বোচ্চটা তো মাত্রই ১ রানের জন্য ৪০০ ছোঁয়নি। কিন্তু একটা জায়গায় মুশফিক-লিটন অনন্য। আর কোনোটাই যে এমন স্কোরবোর্ডে ২৫ রান ওঠার আগেই ইনিংসের প্রথম অর্ধেক শেষ হয়ে যাওয়ার পর নয়।

টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরির মুশফিকও এদিন দারুণ। বরাবরের মতোই গোছানো, ব্যাকরণসিদ্ধ। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই পরিশ্রম, আরও পরিশ্রমকে মূলমন্ত্র মেনে আসা মুশফিকের ব্যাটিংয়েও সেই ছাপ। মুশফিকের একেকটা ইনিংস শ্রমিকের মতো রক্ত-ঘামে তিলে তিলে গড়ে তোলা, লিটন যেখানে ব্যাটকে তুলিতে পরিণত করা এক শিল্পী। সবুজ মাঠ যাঁর ছবি আঁকার ক্যানভাস। কার্যকারিতার দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোটার মূল্যই কম নয়। কিন্তু মন রাঙিয়ে দেওয়ার সহজাত ক্ষমতাবলে লিটনরা চিরদিন দর্শকের কাছে একটু বেশি আদরের। যাঁদের ব্যাটিং দেখে ক্রিকেট লেখকরা ‘কবি’ হয়ে যান। ইংল্যান্ডের বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ফ্র্যাঙ্ক উলিকে দেখে যেমন হয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেট–সাহিত্যের জনক নেভিল কার্ডাস। নইলে কি উলিকে নিয়ে এমন লেখেন, ‘হিজ ক্রিকেট ইজ কম্পাউন্ডেড অব সফট এয়ারস্ অ্যান্ড ফ্রেশ ফ্লেভার। দ্য ব্লুম অব দ্য ইয়ার ইজ অন ইট, মেকিং ফর সুইটনেস।’

লিটন দাসের ব্যাটিং নিয়েও ঠিক এমনই বললে কার্ডাস আপত্তি করতেন বলে মনে হয় না। সফট এয়ারস্, ফ্রেশ ফ্লেভার, ব্লুম, সুইটনেস...লিটন দাসের ব্যাটিংয়ের সঙ্গেও তো কথাগুলো কী সুন্দর মানিয়ে যায়!