পৌরসভায় নজরদারির ক্ষমতা পাচ্ছেন ডিসিরা

| বাংলাদেশ সরকারের লোগো

আরিফুর রহমান ও সামছুর রহমান: স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের আমলাদের দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদের কাজে হস্তক্ষেপ করেন—এমন অভিযোগ প্রায়ই করে থাকেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার নতুন করে দেশের প্রথম শ্রেণির পৌরসভাগুলোতে নজরদারির ক্ষমতা দিতে চায় জেলা প্রশাসকদের (ডিসি)। এই ক্ষমতা ডিসিরা পেলে তাঁরা প্রথম শ্রেণির সব পৌরসভার আয়-ব্যয়, বেতন–ভাতা, দরপত্র আহ্বান, মূল্যায়নসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন করতে পারবেন।

প্রথম শ্রেণির ১৯৪টি পৌরসভায় নজরদারির ক্ষমতা ডিসিদের দিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গত এপ্রিল মাসে লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে ডিসিরা পৌরসভার উন্নয়ন প্রকল্প তদারকি করতে পারবেন। ডিসিরা এখন শুধু দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভা পরিদর্শন করতে পারেন। কিন্তু প্রকল্প দেখভাল কিংবা আয়–ব্যয়ের হিসাব দেখার ক্ষমতা তাঁদের নেই। নতুন প্রস্তাবটি পাস হলে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির মোট ৩২৮টি পৌরসভার সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ডিসিরা। দেশে এখন দ্বিতীয় শ্রেণির পৌরসভা ৮৫টি, তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভা ৪৯টি। কোনো পৌরসভার বার্ষিক রাজস্ব আয় পর পর তিন বছরের প্রতিবছর গড়ে এক কোটি টাকার বেশি হলে সেটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা। একইভাবে পর পর তিন বছরের প্রতিবছর গড় রাজস্ব ৮০ লাখ টাকার বেশি হলে সেটি দ্বিতীয় শ্রেণির পৌরসভা। আর প্রতিবছরে গড় রাজস্ব আয় ৬০ লাখ টাকার বেশি হলে তা তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভা।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ডিসিরা এখন ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন করতে পারেন। কিন্তু প্রথম শ্রেণির ১৯৪টি পৌরসভায় ডিসিদের পরিদর্শনের এখতিয়ার এখন নেই। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো প্রস্তাবটি পাস হলে ডিসিরা পৌরসভা পরিদর্শন করতে পারবেন। এতে পৌরসভার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ডিসিরা পৌরসভা নিরীক্ষা (অডিট) করবেন না। পৌরসভার আয়–ব্যয়ের হিসাব ঠিক আছে কি না কিংবা তাদের দরপত্র মূল্যায়ন সঠিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে কি না, এসব বিষয় দেখবেন।

গত ১০ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভায়’ দেশের পৌরসভাগুলোর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে পৌরসভা পরিদর্শনের ক্ষমতা জেলা প্রশাসকদের দেওয়ার দাবি জোরালোভাবে ওঠে। পৌর কর্মীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য বকেয়া পরিশোধ, নাগরিকদের যথাযথ সেবা প্রদান এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ত্বরান্বিত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।

ওই সভায় আলোচনা হয়, বিদ্যমান পৌরসভা আইনের অস্পষ্টতার সুযোগে অনেক পৌরসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ক্ষমতায় থাকছেন। অনেক পৌরসভায় হোল্ডিং ট্যাক্সের (গৃহকর) মূল্যায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। কোথাও কোথাও অতিরিক্ত গৃহকর আদায় করার কারণে জনগণের ভোগান্তি হচ্ছে। এ বিষয়ে হোল্ডিং করের মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয়েছে কি না, তা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। ছয় সদস্যের কমিটির প্রধান করা হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (নগর উন্নয়ন)।

বর্তমানে দেশের ৩২৮টি পৌরসভার বেশির ভাগের অবস্থাই রুগ্‌ণ। রাজস্ব আয় কম। এর মধ্যে দুই শতাধিক পৌরসভায় ২ থেকে ৬০ মাস পর্যন্ত বেতন-ভাতা বকেয়া। বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৮৭৫ কোটি টাকা। পৌরসভায় স্থায়ী কর্মীর চেয়ে অস্থায়ী কর্মীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পৌরসভাগুলোতে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ বন্ধ করতে বলা হলেও সেটি মানা হচ্ছে না।

পৌরসভার কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ আনতে গত বছরের জুন থেকে প্রথম শ্রেণির পৌরসভাগুলোতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছে সরকার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, পৌরসভার সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল করতে এবং স্বচ্ছতা আনতে সিইও নিয়োগ করা হচ্ছে।

তবে পৌরসভায় সিইও নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই অস্বস্তিতে ছিলেন পৌর মেয়ররা। এর মধ্যে পৌরসভা দেখভালের দায়িত্ব ডিসিদের দেওয়ার প্রস্তাবে আরও ক্ষুব্ধ ও নাখোশ মেয়ররা। তাঁরা বলছেন, এর মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের দাপট আরও বাড়বে। আর জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা খর্ব হবে।

পৌর মেয়রদের সংগঠন মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ম্যাব) সভাপতি ও নীলফামারী পৌরসভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ বলেন, পৌরসভা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানেও যদি আমলাদের নিয়ন্ত্রণে শুরু হয়ে যায়, তাহলে জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা আর থাকে না। পৌরসভার আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতিবছর সরকার নিরীক্ষা করে থাকে। নতুন করে ডিসিদের এই দায়িত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয় না।

স্থানীয় সরকারের আরেক প্রতিষ্ঠান উপজেলা পরিষদে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বিষয়টি এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। উপজেলা পরিষদ আইনে ১২টি মন্ত্রণালয়ের ১৭টি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঠপর্যায়ে উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিপত্র জারি করে এসব বিভাগের কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য গঠিত কমিটিগুলোতে ইউএনওদের সভাপতি করেছে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, ইউএনওদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব তাঁদের কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে মাঠপর্যায়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত (এডিপি) প্রকল্পের মূল্যায়নের দায়িত্বও ডিসিদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন প্রকৌশলীরা। শেষ পর্যন্ত ওই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রকৌশলীদের আন্দোলনের মুখে মাঠপর্যায়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প ডিসিরা মূল্যায়ন করছেন না।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বায়ত্তশাসনের বদলে আরও বেশি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক প্রণব কুমার পান্ডে। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারে আমলাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর এসব সিদ্ধান্ত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পরিপন্থী। এতে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাই খর্ব হয়। পৌরসভায় নজরদারি করতে হলে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।