মোশতাক আহমেদ, ঢাকা: নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পেয়েছে। মাধ্যমিকের সঙ্গে সমন্বয় না করে এবং পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের আগেই প্রাথমিক স্তরের বিস্তারিত শিক্ষাক্রম অনুমোদন দিয়েছে প্রাথমিকের জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি)। যেখানে মাধ্যমিক স্তরের শেখানোর প্রক্রিয়ার (শিখন) সঙ্গে প্রাথমিক স্তরে শেখানোর প্রক্রিয়ায় মিল নেই। প্রাথমিকে মূলত আগের (২০১২ সালের) শিক্ষাক্রমকেই পরিমার্জন করা হয়েছে।

মাধ্যমিকের নতুন শিক্ষাক্রমে যেখানে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে সার্বিকভাবে যোগ্য করে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে; সেখানে প্রাথমিকে অ্যাকটিভ লার্নিংয়ের (সক্রিয় শিখন) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাকটিভ লার্নিং শিক্ষার্থীকে শিখনের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণ চর্চা করার সুযোগ করে দেয়, যা মূলত অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন ধারণার একটি মাত্র উপায়। আর অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনে অনেকগুলো ধাপ ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জন করে তা বাস্তবে প্রয়োগ করার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায়।
বিজ্ঞাপন

প্রাথমিকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে সমন্বিতভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটি কার্যত ভেস্তে গেল।

নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই বলছেন, প্রাথমিকের এমন সিদ্ধান্তে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মূল স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। বরং উল্টো কিছু সমস্যার আশঙ্কা আছে। কারণ, শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তরে একভাবে শিখে যখন মাধ্যমিকে পড়তে যাবে, তখন খাপ খাওয়াতে অসুবিধা হবে।

অবশ্য এনসিটিবির চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) মো. মশিউজ্জামান বলেছেন, প্রাথমিক কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলেছে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী প্রাথমিকের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করবে।

দেশের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে বড় রকমের পরিবর্তন এনে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। যদিও শুরু থেকেই শেখানোর প্রক্রিয়াটি কেমন হবে, তা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শাখার মধ্যে ‘ঠেলাঠেলি’ চলছিল। এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়, প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে এ বছরের শুরুতে নির্ধারিতসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। এরপর আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে বাস্তবায়ন শুরু হবে। এভাবে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে এ পর্ব শেষ হবে।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে মাধ্যমিক স্তরের ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। একই সময় থেকে ১০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণিতেও পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন শুরুর কথা থাকলেও এখন এনসিটিবির সূত্রগুলো বলছে, আসন্ন ঈদুল ফিতরের আগে প্রাথমিকে তা শুরুর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, এখনো বই লেখা হয়নি।

এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত ২৩ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বাধীন এনসিসিসিতে প্রাথমিকের স্তরের বিস্তারিত শিক্ষাক্রম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ শিক্ষাক্রমের রূপরেখা এখনো আন্তমন্ত্রণালয় সভাতেই অনুমোদন হয়নি। এমনকি নিয়মিত চেয়ারম্যান না থাকায় এনসিটিবির বোর্ড সভাতেও প্রাথমিকের শিক্ষাক্রম অনুমোদন হয়নি।

শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ভাষ্য, প্রথমত পরীক্ষামূলক শুরুর আগেই বিস্তারিত শিক্ষাক্রম অনুমোদন করা পদ্ধতিগতভাবে সঠিক হয়নি। কারণ, পরীক্ষামূলকভাবে চালুর প্রভাব দেখে তার ভিত্তিতে পরিবর্তন করে শিক্ষাক্রম অনুমোদন করা যৌক্তিক। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিকে যেভাবে শিক্ষাক্রম অনুমোদন করা হয়েছে, তা ‘অ্যাকটিভ লার্নিং’কে প্রাধান্য দিচ্ছে, অথচ বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীর যোগ্যতার পারদর্শিতা অর্জনে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন ধারণাকে সর্বাধিক ব্যবহার করা হয়।

কাজেই শিখনের প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা দেবে, যা শিক্ষার্থীর প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরে উন্নয়নের ক্ষেত্রে যোগসূত্র রাখতে সমস্যার সৃষ্টি করবে। তৃতীয়ত, শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার কোনো স্থান নেই। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

অবশ্য এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেছেন, এনসিসিসি সভায় আলোচনা হয়েছে। পরে যদি সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তখন তা করা হবে। আর তাঁরা নতুন করে শিক্ষাক্রম করছেন না। আগের শিক্ষাক্রমকেই পরিমার্জন করেছেন। অ্যাকটিভ লার্নিং হলেও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের সুযোগও রাখা হয়েছে। এখন বিস্তারিত শিক্ষাক্রম অনুমোদন দেওয়ার মাধ্যমে বই লেখা হবে। এরপর পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন শুরু হবে।

এনসিটিবির সূত্রমতে, প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৪ (পিইডিপি)–এর আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন আগেই প্রাথমিক স্তরের যোগ্যতা নির্ধারণসহ শিক্ষাক্রমের কিছু কাজ ঠিক করে রেখেছিল। মূলত সেটিই এখন এদিক-ওদিক করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

প্রাথমিকের নতুন সিদ্ধান্তের বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে কি না, তা এখনো ধোঁয়াশার মধ্যেই থাকছে।